বিশ্বাস

মাঝে মাঝে আমার নিজেকে বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়, অন্যকে তো দুরের কথা ! বিশ্বাসটা আসলে কাউকে করা যায়না, কিংবা বানানো যায়না। বিশ্বাসটা এমনি এমনিই জন্ম নেয়, যাকে বিশ্বাস করব তার কাজের উপর। আমার কাজ, চলাফেরা, আচার-আচরনই আমাকে বিশ্বাস করত শেখাবে তাকে। হয়ত হাজার বছর একিই ছাদের নিচে বসবাস করেও কাউকে বিশ্বাস করা যায়না কিংবা বিশ্বাস করে হয়ে ওঠেনা। আবার কখনো কখনো এক মুহুর্তের আচরনেই বিশ্বাস জন্ম নেয়।

আমার ধারনা বাংলা ডিকশনারীতে যতগুলো শব্দ আছে তার মধ্যে বিশ্বাস শব্দটা সবচেয়ে খারাপ ও ভয়ংকর । এই শব্দটি যে কত মানুষের কত ধরনের ক্ষতি করেছে, তা ভুক্তভুগি ছাড়া ব্যখ্যা করা সম্ভব নয়।

এক : একটি মেয়ে বা ছেলে শুধু অল্পদিনের চেনা জানা বা পরিচয়ের উপর বিশ্বাস করে, আগামীদিনগুলো তাকে সুখে রাখবে, ভালবাসবে, নিরাপত্তা দেবে গত বিশ বছরের মা-বাবার বিশ্বাস ভঙ্গ করে অজানার পথে পাড়ী জমায়। 

দুই : মা বাবা সন্তাদের বিশ্বাস করে তাদের বা্ইরে ছেরে দেন। কাউকে কলেজ হোস্টেলে আবার কাউকে আলাদা বাসায় রেখ উন্নত শিক্ষা গ্রহণ করে মানুষের মত মানুষ হওয়ার প্রত্যাশায় শুধু মাত্র বিশ্বাস এর উপর নির্ভর করে তাদের বাইরে থাকার অনুমোতি দেন। এই বিশ্বাসই মাঝে মাঝে কাল হয়ে দাড়ায়। প্রতিনিয়ত বিশ্বাস ভংগ করে অনেকেই অধপতনের সাগরে তলিয়ে যাচ্ছে। কেউ স্বামী-স্ত্রী সেজে একই বাসায় থাকছে দিনের পর দিন। মা-বাবা জানতেও পারছেনা। তারা তাদের পুরানো বিশ্বাস নিয়েই পরে আছে। অথচ তারা জানছেনা তাদের সন্তান তাদের বিশ্বাস ভংগ করে আর একটা মানুষকে বিশ্বাস করে একই ছাদের নীচে রাত কাটাচ্ছে। 

তিন : নববধুর কত অঘাত বিশ্বাস বাসর ঘরে তার স্বামীর দেয়া মিথ্যা প্রতিশ্রুতির প্রতি। অথচ তাদের স্বামী নামের দেবতাটি প্রতিদিন যে কি অবিশ্বাসের কাজ করে যাচ্ছে তার খবর রাখেনা নিষ্পাপ বধুটি। এই বিশ্বাসই তাকে একদিন ডুবিয়ে মারে। অনেক সংসারেই দেখা যাচ্ছে বধূ বিশ্বাস নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকে আর কখন যে তার সম্পর্কের অংশিদার জন্ম নেয় সে খবরও পায়না। তাইত আজকাল শুধু বিশ্বাস নিয়ে ঘুমিয়ে থাকা নারীদের পচিশ বছর সংসার করার পরও ঘর ভেঙ্গে যায়। 

চার : আমাদের অফিসের মেঝ বাবু নিশ্চিন্ত মনে বিশ্বাস নিয়ে বসে আছে। দশ বছর হয়ে গেছে আর চাকুরী হারানোর ভয় নেই। তাই চাকুরী খুচ্ছেনা। এমন কি মাঝে মাঝে ইন্টারভউ দিয়ে নিজের যোগ্যতাটুকু ও যাচাই করে দেখেনা, শুধু বিশ্বাস নিয়ে ঘুমিয়ে আছে। আর একদিন রাতের বেলা তার বিশ্বাস ভংগ করে রাতের আধারেই চাকুরীটা পালিয়ে গেল, সকালে অফিসে আসতেও হলোনা। অঘাত বিশ্বাসের কারনে সংসার নিয়ে শেষ বয়সে তাকে পথে বসতে হলো।

পাঁচ : বিশ্বাস তো আমাকেও তুমি করেছিলে সেই দশ বছর আগে। গ্রামের সহজ সরল মেয়েটাকে দেয়া সেদিনের প্রতিশ্রুতিগুলো কতনা বিশ্বাস এর সাথেই গ্রহন করে দশ বছর ঘুমিয়ে ছিল। আর তীলে তীলে বার বার ওর অজান্তেই বিশ্বাস ভংগ করে গেছি, জানতেও পারোনি। এখন তোমার কাছেতো মনে হতেই পারে, যে আমাকে বিশ্বাস করাটা তোমার জন্য ভুল ছিল। বরং প্রথমদিন থেকেই অবিশ্বাসাসের নজরে বন্দি করে রাখলে আজ হয়ত বিশ্বাস ভঙ্গ হওয়ার যন্ত্রনাটুকু পেতে হতনা। কিংবা হয়ত এতটা বিশ্বাস ভংগ হতনা। আমি হাজার ভাল হলেও ওর পক্ষে কি আমাকে আগের মত বিশ্বাস করা সম্ভব ?

ছয় : মাঝে মাঝে একটা কথা খুব মনে পড়ে, ঐ স্ত্রী সবচেয়ে হতভাগা, যার রয়েছে অবিশ্বাসী স্বামী। আর স্বামী সবচেয়ে হতভাগা, যার রয়েছে অবিশ্বাসী স্ত্রী। মাঝে মাঝে ভাবতে অবাক লাগে এই সব অবিশ্বাসী স্বামীদের বউদের কথা ভেবে। আহারে কতনা কষ্টে কাটছে ওদের প্রতিটি মুহুর্ত। সারাদিনের ঘরের কাজ, বাচ্চার স্কুল, শশুড়-শাশুড়ী তার মাঝে নিজেকে তৈরি করা স্বামী দেবতাটির ভাল লাগার জন্য। এরই মাঝে যদি সারাক্ষন একটা ভয় ভয় দুশ্চিন্তা নিয়ে সময় কাটাতে হয়, এই বুঝি স্বামীটি বেহাত হয়ে গেল, তার সর্ম্পর্কের অংশিদারে এসে তার আপন পৃথিবীটাকে নরবরে করে দিল। এভাবে কি মানুষ বেচে থাকতে পারে ?

সাত : প্রতিদিন সন্ধ্যায় স্বামী ঘরে ফেরার পর যদি তার শার্ট  থেকে লম্বা চুল আর লিপিস্টিক এর দাগ খুজে বেরাতে হয় । তাহলে শাড়ী পরে হাতে কফি নিয়ে ভেজা চুলে কে বেলকুনীতে অপেক্ষা করবে ?

আট : আমি শুনেছি সারাদিন স্ত্রীরা হাজারো কাজে ব্যস্ত থাকে। এই সারাদিনের কাজের কষ্ট, গ্লানি আর পরিশ্রমে তাদের অন্তরে তীল তীল করে বেদনার বালু চর জমতে থাকে। সন্ধ্যা বেলা স্বামী যখন অফিস থেকে ফিরে হাসি মুখে বুকে টেনে নেয়, তখন সারাদিনের সেই কষ্টগুলো গলে জলের স্রোতের মত বিলিন হয়ে যায়। আর ঐ স্ত্রীটি আগামীকালের জন্য বেঁচে থাকার সাহস, শক্তি ও মনবল অর্জন করে নেয়। আর সন্ধ্যেবেলা স্বামী দেবতাটি যদি নিজের পৃথিবী নিয়ে পরে থাকে, স্ত্রীর অবিশ্বাসগুলোকে আরো তরতাজা করে তোলে, তাহলে সারাদিনের সেই বেদনার বালুচর গুলো একদিন পর্বত আকার ধারন করে। 

আবার কখনো কখনো নষ্টা চরিত্রের সার্টিফিকেট নিয়ে ঐ  স্ত্রীকে নিজের পৃথিবী থেকে সরে দাড়াতে হয়। কিন্তু কেন ? ও তোমাকে বিশ্বাস করেছিল বলে । হয়ত এমনটা প্রতিদিনই আমাদের চারপাশে ঘটছে আমরা খবরও রাখিনা। আমরা শুধু তাদের দোষটা নিয়ে দুচোখ বন্ধ করে মাইকিং করে বেড়াচ্ছি। সেই শব্দে ওদের না বলা কথাগুলো অস্পষ্ট কিংবা চাপা পরে যায় । 

নয় : আজ কদিন আমার এক কলিগের কাজে মন নেই। সারাক্ষন স্ত্রী হারানোর চিন্তায় ডুবে থাকে। আজ অনেকদিন পর সেই পুরানো খালাত ভাইটা আবার বেড়াতে এসেছে, তাই আজ অফিস করবে। বিকালে ছুটি লাগবে । এভাবে কত বিকেল ছুটি নেবে বন্ধু  ?  কেউ যদি তার নিজের কদর বুঝতে না পারে, নিজেকে বিলিয়ে দেয় সস্তা কোন দালালের হাতে ।  সেখানে তোমার অবিশ্বাস আর বিশ্বাস কি কাজে আসতে পারে ? 

তাহলে শোন, ভালবেসে মা-বাবার অমতে বিয়ে করেছি ছিল অঘাত বিশ্বাস। কোন দিন বিন্দুমাত্র অবিশ্বাস করিনি। আমি প্রায়ই অফিসের কাজে নাইট করতাম। অধিক রাত করে বাসায় ফেরতাম। ওকে বিশ্বাস করে একা রেখে যেতাম। ও মাঝে মাঝে বলত ওর ভয় করে । যে জিনিসগুলো হারানো নিয়ে ওর ভয় করত, কবে যে আমার বিশ্বাস ভঙ্গ করে সেই জিনিসগুলো অন্যের হাতে তুলে দিয়েছে, আমি টেরই পাইনি।  অল্পকিছুদিন পর লক্ষ্য করলাম ওর আর ভয় করেনা। তখন বুঝলাম ওর আর হারাবার কিছুই বাকি নেই, তাই ভয়ও নেই। যদিও এসব কথা অনেক দেরী করে বুঝলাম। এই বিশ্বাসই আমাকে ডুবিয়েছে, তখন প্রথম থেকেই যদি অবিশ্বাসের গাছটাকে জল দিয়ে বড় করে তুলতাম। তাহলে আজ আর কষ্ট পেতে হতনা।

সন্দেহ আর অবিশ্বাস এই শব্দ দুটিকে ভালবাসতে শুরু করো, তাহলে অন্তত বিশ্বাস ভঙ্গ হওয়ার যন্ত্রনা নিয়ে বাকিটা জীবন কাটাতে হবেনা। 


সময় পেলেও আর লিখবনা !

0 comments:

Post a Comment

" কিছু স্বপ্ন আকাশের দূর নীলিমাক ছুয়ে যায়, কিছু স্বপ্ন অজানা দূরদিগন্তে হারায়, কিছু স্বপ্ন সাগরের উত্তাল ঢেউ-এ ভেসে যায়, আর কিছু স্বপ্ন বুকের ঘহিনে কেদে বেড়ায়, তবুও কি স্বপ্ন দেখা থেমে যায় ? " সবার স্বপ্নগুলো সত্যি হোক এই শুভো প্রার্থনা!