আদিকাল থেকে মানুষ কোন না কোন বস্ত্র ব্যবহার করে আসলেও আসলে সেলাই মেশিনের সাহায্য বস্ত্র ব্যবহার শুরু হয় সর্বপ্রথম ১৭৫৫ সালে। সেখান থেকে বাংলাদেশে এর ব্যবহার শুরু হয় অনেক পরেই বলা যাই । বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পের যাত্রা শুরু হই ১৯৬০ সালে ।
গার্মেন্টস শিল্প গত ৩০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফ
ব্লাডে পরিণত হয়েছে । বিশ্বে তৈরি পোশাক রফতানিতে বর্তমানে চীনের পরেই বাংলাদেশের
স্থান । বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বাংলাদেশের সর্বমোট ২৫ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয়ের
ক্ষেত্রে এককভাবে শতকরা ৮০ ভাগ অর্জনের পাশাপাশি গার্মেন্টস খাত প্রত্যক্ষভাবে
প্রায় ৪০ লাখ দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান করছে । আর পরোক্ষভাবে আরো এক থেকে দেড়
কোটি মানুষের কর্মসংস্থানেও ভূমিকা রাখছে এ শিল্প । শতভাগ ব্যক্তি উদ্যোগে
প্রতিষ্ঠিত এবং দেশের উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক দক্ষতায় পরিচালিত তৈরি পোশাক শিল্প
আজ একটি সফল কাহিনী । তৈরি পোশাক শিল্প গুরুত্বের বিচারে এখন এমন স্তরে উপনীত
হয়েছে যে দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা অনেকাংশেই আজ এই শিল্পের উপর নির্ভরশীল।
বেড়ে ওঠা :
১৯৮৫ সাল নাগাদ
বাংলাদেশ শক্তিমান পোশাক সরবরাহকারী হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপের বাজারের ঐতিহ্যবাহী সরবরাহকারীদের কাছে শক্তিশালী
প্রতিযোগী হিসেবে পরিণত হয়। ১৯৮৬ সাল থাকে বাংলাদেশ ইউএসএ এবং কানাডার
ক্রমবর্ধমান কোটা বাধ্যবাধকতার আওতাভুক্ত হয়। ১৯৮০-র দশকে বেশকিছু দেশে তৈরি
পোশাক শিল্প বিপত্তিকর অবস্থায় পড়ে। অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে শ্রীলঙ্কা এবং
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য কয়েকটি দেশে উৎপাদন খরচ দ্রুত বেড়ে যায়। ক্রেতারা বিকল্প উৎস খুঁজতে থাকে এবং সস্তা
শ্রমিক ও বড় আকারের রপ্তানি কোটার সুবাদে বাংলাদেশ একটি আদর্শ বিকল্প হিসেবে
প্রতীয়মান হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে অব্যাহতভাবে কোটামুক্ত মর্যাদা এবং
জিএসপি সুযোগ-সুবিধা দিতে থাকে। তাছাড়া, ইউএসএ এবং কানাডা বাংলাদেশের জন্য বেশ
বড় আকারের কোটা বহাল রাখে। এসব সুযোগ গ্রহণ করে বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে ইউএসএ,
কানাডা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজার নিশ্চিত করে। তৈরি পোশাক শিল্প বেড়ে ওঠার
ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ উপাদানগুলি কার্যকর ভূমিকা রাখে এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সস্তা
শ্রমিকের সহজলভ্যতা বাংলাদেশকে তুলনামূলক সুবিধা এনে দেয়। সরকারের নীতিসমূহ এই
শিল্পখাতের দ্রুত সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে অবদান রাখে। সরকার পিঠাপিঠি প্রত্যয়পত্রের
মাধ্যমে শুল্কমুক্ত কাপড় আমদানি, শুল্কাধীন গুদাম ব্যবহারের সুবিধাদি, সুদের হারে
বিশেষ ছাড়, রপ্তানির জন্য নগদ অর্থে প্রণোদনা, রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকার
সুবিধাদিসহ বিভিন্ন ধরনের উৎসাহ-উদ্দীপনা যুগিয়ে ছিল । এছাড়া সরকার আমদানি ও রপ্তানি ক্ষেত্রে
কার্যকর কিছু আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপও গ্রহণ করে ।
পোশাক শিল্পের
বিস্ময়কর প্রবৃদ্ধির জন্য অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক উভয় উপাদানই ভূমিকা রেখেছে।
বাহ্যিক কারণের একটি ছিল গ্যাট (GATT) অনুমোদিত ‘মাল্টি ফাইবার অ্যারেঞ্জমেন্ট’
(এমএফএ)-এর অধীনে কোটা পদ্ধতি। এই কোটা পদ্ধতিতে তৈরি পোশাকের আন্তর্জাতিক আউট
সোর্সিং পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে বেশি দামে প্রস্ত্ততকারী দেশ থেকে কম দামে
প্রস্ত্ততকারী দেশে স্থানান্তর করা হতো। এমএফএ’র প্রয়োগ বাংলাদেশের জন্য অনেকটা
আশির্বাদ বয়ে আনে। নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয়
ইউনিয়ন থেকে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত দেশ হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের
বাজারে পোশাকের একটি উল্লেখযোগ্য ‘কোটা’ রপ্তানির সুযোগ পায়। ইউরোপিয়ান
ইউনিয়নের কোটামুক্ত বাজারের পাশাপাশি বাংলাদেশকে জিএসপি সুযোগ দেয়া হয়।
বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বৃহৎ সরবরাহকারী পোশাক প্রস্ত্ততকারীরা কোটা সুবিধা এবং সস্তা শ্রমের দেশে
কারখানা পুনঃস্থাপনের কৌশল গ্রহণ করে। বাংলাদেশকে তারা সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে
চিহ্নিত করে। এ কারণেই বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের কারখানা গড়ে ওঠে ।
এ ছাড়াও আরও কিছু কিছু কারণ বাংলাদেশে
তৈরি পোশাক শিল্প গড়ে ওঠার পেছনে অবদান রেখেছে। কোনো কোনো দেশ যেমন শ্রীলংকা এবং
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় শ্রম মজুরি দ্রুত বেড়ে যায়। ক্রেতারা বিকল্পের সন্ধানে
ছোটে। শান্তিপূর্ণ কাজের পরিবেশ, সস্তা শ্রম এবং বড় আকারের কোটা সুবিধা প্রাপ্তির
কারণে বাংলাদেশ আদর্শ স্থান হিসেবে বিবেচিত হয় । তাছাড়াও পর্যাপ্ত পরিমাণে
প্রশিক্ষণযোগ্য শ্রমিকের সরবরাহ। সরকারের অভ্যন্তরীণ নীতিমালাও এই শিল্প গড়ে ওঠার
পিছনে অবদান রেখেছে। সরকারের সুযোগ সুবিধার মধ্যে ব্যাক-টু-ব্যাক এল.সি (লেটার অব
ক্রেডিট)। পণ্য গুদামজাতকরণ সুবিধা (শুল্ক আদায় সাপেক্ষে) হ্রাসকৃত সুদে ঋণ, নগদ রপ্তানি
সুবিধা, রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা তৈরি ইত্যাদি। এছাড়াও আমদানি রপ্তানি
নীতিমালা গতিশীল করতে সরকার অনেকগুলি বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
পোষাক শিল্প প্রতিষ্ঠানে শিশুশ্রম একটি বড়
বিষয় প্রতিটি বায়ারের কাছে । এই খাত থেকে শিশুশ্রমিক বর্জনের আন্তর্জাতিক দাবিতে
বাংলাদেশ অত্যান্ত ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। ১৯৯৪ সালের ৪ জুলাই ঢাকায় বিজিএমইএ,
আইএলও, ইউনিসেফ এবং যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস যৌথভাবে এক স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করে
এবং বাংলাদেশ ১৯৯৬ সালের নভেম্বর
মাস থেকে শিশু শ্রম নিষিদ্ধ
করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়। এটি বাংলাদেশের প্রতি কারখানায় সফলভাবে কার্যকর করা হয়।
অর্থনৈতিক সমর্থন পেলে শিশুরা ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত
স্কুলে অংশগ্রহণ করতে পারে । আর এই লক্ষেই বিজিএমইএ এবং কিছু এনজিও যৌথভাবে শ্রমজীবী শিশুদের জন্য কিছু স্কুল পরিচালনা করছে। যা
প্রতিটি বায়ারের কাছে গ্রহনযোগ্যতা পেয়েছে ।
সকল বায়ারেরই কাররখানার মালিকদের প্রতি
দাবি হলো আইন মেনে চলা, ন্যূনতম মজুরি চালু করা, কাজের পরিবেশ, ইকো-লেবেলিং
ইত্যাদি ক্ষেত্রে পোশাক শিল্প শ্রমিকদের দাবি বাস্তবায়ন করা এবং শ্রমিকদের ট্রেড
ইউনিয়ন গঠন করার এবং/অথবা ট্রেড ইউনিয়নে অংশগ্রহণ করার অনুমতি দেওয়া । আর এ
ব্যপারে বাংলাদেশ অনেকটা সক্রিয়ভাবে গুরুত্বের সাথে বিষয়গুলো মেনে চলছে, যার ফলে অত্রি
দ্রুত সময়ে গার্মেন্টস শিল্পগুলো প্রসার লাভ করে ।
রপ্তানীর
ইতিহাস :
বাংলাদেশে প্রথম গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি স্থাপিত হয় ১৯৬০ সালে ঢাকার উর্দুরোডে যার নাম “রিয়াজ গার্মেন্টস” । প্রাথমিকভাবে রিয়াজ গার্মেন্টস এর উতপাদিত পোশাক স্থানীয় বাজারে বিক্রয় করা হতো । ইংরেজি ১৯৬৭ সালে রিয়াজ গার্মেন্টস এর উতপাদিত ১০,০০০ পিস শাট বাংলাদেশ হতে সর্বপ্রথম বিদেশে (ইংল্যান্ডে) রপ্তানি করা হয় ।
গার্মেন্টস প্রস্তুতকারক ও গার্মেন্টস রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে প্রকৃতপক্ষে ১৯৮১-৮২ সালে ০.১ বিলিয়ন টাকার রেডিমেইড গার্মেন্টস রপ্তানি করে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের পদচারনা আরম্ভ হয় । উক্ত সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গার্মেন্টস শিল্পের তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল না । অথচ মাত্র ১০ বতসরের ব্যবধানে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির পরিমান ১৯৯২-৯৩ সালে ১৪৪৫ মিলিয়ন ইউ.এস ডলারে উন্নীত হয় । এরপর থেকে বাংলাদেশকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি । দিনকে দিন পোশাক রপ্তানির পরিমান বেড়েই চলেছে । যেখানে ২০১১-১২ অর্থবছরে সর্বমোট পোশাক রপ্তানির পরিমান ছিল ১৯,০৮৯.৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সেখানে তা ২০১২-১৩ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১,৫১৫.৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আয়
৩০,১৮৬.৬২ মিলিয়ন
ডলার ।
১৯৮২ সালে কারখানার সংখ্যা ছিল ৪৭ এবং
১৯৮৫ সালে ৫৮৭, আর ১৯৯৯ সালে ২,৯০০টিতে উন্নীত হওয়ার মধ্য দিয়ে এই শিল্পের
সাফল্য স্পষ্ট হয়ে উঠে। এই ধারাবাহিকতায় উৎপাদন ও রপ্তানি ক্ষমতা সমানতালে বৃদ্ধি পেয়ে
২০০৯ সালে কারখানার সংখ্যা ৩ হাজারে উপনীত হয়। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে বিশ্বের দ্বাদশ
বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। তন্মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে
বাংলাদেশের স্থান ষষ্ঠ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে টি-শার্ট রপ্তানিতে বাংলাদেশ
পঞ্চম স্থান দখল করে আছে। ১৯৯০-এর দশকে এ শিল্পখাতের সম্প্রসারণ ঘটেছে বার্ষিক
প্রায় ২২ শতাংশ হারে।
অথনীতি ও গার্মেণ্টস :
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পোশাক শিল্প সুদূরপ্রসারি অবদান রেখে চলেছে । ইপিবি এভং বিজিএমই-এর গবেষণা সেলের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত তিন অর্থ বছর ধরে প্রতিবছর নতুন বাজেটের রপ্তানি আয় দ্বিগুণ হারে বাড়ছে । গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে নতুন বাজারের সম্মিলিত প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২১ দশমিক ১৫ শতাংশ । আগের অর্থবছরে এর হার ছিল ১২ দশমিক ৭১ শতাংশ । ২০১১-১২ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ । পুরনো এবং নতুন সব বাজারে পোশাক রপ্তানি বাড়ছে । বিশেষ করে নতুন বাজারের রপ্তানি বেশ ভালো । সমাপ্ত অর্থ বছরে নতুন বাজার থেকে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে । ২০১২-১৩ অর্থ বছরে এসব বাজারে প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৭১ শতাংশ যা ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বেড়ে হয়েছে ২১ দশমিক ১৫ শতাংশ ।
জানা গেছে, ২০০৯ সালে বিশ্ব মন্দায় প্রধান প্রধান বাজারে রপ্তানি কমে যাবার সম্ভাবনায় ছোট ছোট নতুন বাজারের পক্ষ থেকে ও প্রচলিত বাজারের পাশাপাশি নতুন বাজার সম্প্রসারণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে । ফলে নতুন বাজার থেকে ভালো সারা পাওয়া যাচ্ছে । আরো জানা গেছে, নতুন বাজার সম্প্রসারণে ইপিবির ভূমিকাই মুখ্য । বাজার সম্প্রসারণে সরকারি পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে এটা সম্ভব হয়েছে । নতুন বাজার হিসেবে তুরস্ক, অষ্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান, কোরিয়া, রাশিয়া, ব্রাজিল, মধ্যপ্রাচ্য, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, আর্জেন্টিনা, চিলি, উরুগুয়ে, পর্তুগাল, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ অন্তত ২৫টি দেশকে নতুন বাজার হিসেবে বিবেচনা করেন রপ্তানিকারকরা । আলোচ্য এসব বাজারের মধ্যে শীর্ষে ছিল তুরস্ক । তুরস্কে রপ্তানি হয়েছে ৬২ কোটি ২৩ লাখ ডলারের পণ্য । এসব বাজারের মধ্যে গত অর্থ বছরে শীর্ষে থাকা জাপান এবার দ্বিতীয় স্থানে নেমে এসেছে । তবে গত বছরের ৪৯ কোটি ডলার থেকে আয় বেড়ে হয়েছে ৫৭ কোটি ২২ লাখ ডলার । তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া । আগের বছরের আয় থেকে সামান্য বেড়ে রপ্তানি হয়েছে ৪৩ কোটি ডলারের পণ্য, নতুন বাজারের মধ্যে ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়া সব দেশেই আগের বছরের তুলনায় রপ্তানি আয় বেড়েছে । অন্যদিকে প্রচলিত বাজার হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে প্রধান ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র, দ্বিতীয় জার্মানি এবং তৃতীয় ফ্রান্স । তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্বের প্রায় সব দেশেই কম বেশি বাংলাদেশী পোশাক রপ্তানি হচ্ছে । রপ্তানি বাজার হিসেবে নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশের ওপর নির্ভরতা কমাতে চান তারা । এ কারণে নতুন নতুন বাজারের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে তারা । বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প অগ্রবর্তী প্রভাবের ফলে ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়নের দ্বার উদঘাটন করেছে, যা একমাত্র
সম্ভব হয়েছে বতমান সরকারের নিরলস প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতার ফলে ।
প্রতিকুল অবস্থা :
গার্মেন্টস শিল্পের নিরাপত্তা রক্ষায় সরকার যথেষ্ট আন্তরিক, সাথে নিরলস
চেষ্টা করে যাচ্ছে “বিজিএমইএ”
“বিকেএমইএ” ও অন্যান্য এনজিও প্রতিষ্ঠান । তারপরও অনেক সময় দেশের বিভিন্ন সময়ের
রাজনৈতিক অবস্থা ও শ্রমিক অসন্তোষ এর কারণে মাঝে মাঝে বিভিন্ন এলাকায়, বিভিন্ন
প্রতিষ্ঠানে নৈরাজ্যকর অবস্থা বিরাজ করছে, সাথে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটতো আছেই । এসব কারণে মাঝে মাঝে ফ্যাক্টরি বন্ধ থাকায় বিদেশী বিনিয়োগ ও রফতানি কমে যাচ্ছে বা যেতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের পোশাক শিল্পে অশনি সংকেত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। পোশাক শিল্পের ঈর্ষণীয় সাফল্য ব্যর্থ করে দিতে বাংলাদেশের ইমেজ প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচষ্টা করা হচ্ছে। এ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশের অবকাঠামো ও স্থিতিশীলতা সম্পর্কে বায়ারদের ভুল বার্তা দেয়া হচ্ছে। বায়ার ও বিদেশী ভোক্তাদের কাছে নেতিবাচক ধারণা দিতে দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, ঘনঘন শ্রম অসন্তোষ, আইন
অনুযায়ী শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা প্রদান না করা, বিভিন্ন সময়ে শ্রমিক নেতা হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন বিষয় ফোকাস করতে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা কাজ করে যাচ্ছে। গুজব ছড়িয়ে শ্রম অসন্তোষ ও সহিংসতার পেছনে পোশাক শিল্পের প্রতিযোগী দেশগুলোর ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শ্রম অসন্তোষের পেছনে শ্রমিক সংগঠনগুলোকে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতিনিয়ত শ্রম অসন্তোষের কারণে কারখানা বন্ধ রাখা হচ্ছে। এর ফলে কারখানার উতপাদন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ও নষ্ট হচ্ছে।
বিশেজ্ঞদের ধারণা, বাজার নষ্ট করতে দেশীয় এজেন্টদের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশের চক্রান্ত, ঝুট ব্যবসার অব্যবস্থাপনা, শ্রমিকদের সঙ্গে কতিপয় এনজিওর অতিমাত্রায় যোগাযোগ এবং বিভিন্ন সময়ে গঠিত একাধিক তদন্ত কমিটির সিদ্ধান্ত ও সুপারিশ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না হওয়া, কারখানার সাথে সাথে শ্রমিকদের পরিপূন উন্নতি না হওয়া, সব
প্রতিষ্ঠানগুলো একি হারে সুযোগ-সুবিধা না দেওয়েই দায়ী । এ অবস্থায় সুযোগ নিচ্ছে প্রতিবেশী প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো, আন্তর্জাতিক বাজারে যার পোশাক রফতানি বাংলাদেশের চেয়ে এখনো অনেক কম। বাংলাদেশ যেখানে বছরে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি করে, সেখানে তাদের রপ্তানী প্রায় অর্ধেক এর কাছাকাছি
। তবে তাদের চক্রান্ত সফল হলে শিগগিরই তারা পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে যাবে। কারণ বিদেশী চক্রান্তের মুখে বাংলাদেশের রফতানিমুখী পোশাক শিল্প ধীরে ধীরে নিস্তেজ হতে চলেছে। এ খাতের শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যে দূরত্ব ও বিভাজন সৃষ্টি করে এর সুযোগ নিচ্ছে প্রতিদন্দি রাষ্ট্রগুলো ।
প্রতিকুলতা থেকে মুক্তির পথ :
1.গার্মেন্টসে সন্ত্রাসী ঘটনার পেছনে থাকা ইন্ধনদাতা ও প্রকৃত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সরকারকে আরো কঠোর হতে হবে, তাছাড়া এ সেক্টরের ভবিষ্যত নিয়ে শংকামুক্ত হতে পারবে না কেউ। প্রকৃত সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় এনে
দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে । প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার এবং মালিক ও শ্রমিকদেরকে পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে ।
2.এই সেক্টরের মূল সমস্যা বেতন-ভাতা নয়। যদিও গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো হয়েছে এবং
বছর বছর বাড়ানো হচ্ছে । তারপরও শুধু বেতন বাড়ালে তো হবে না। সরকার যদি বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারে তাহলে বেতন বাড়িয়ে কোনো লাভ হবে না। তাই বতমান বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য সরকারকে আরো
গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে শ্রমিকরা বতমান প্রাপ্য বেতনে ভাতায় স্বাভাবিক জীবন যাপন
করতে পারে এবং তাদের মাঝের আথনৈতিক হতাশা, দুবল মনস্তাত্তিক বিষয়গুলো থেকে মুক্তি
পারে । এ্টাই শ্রমিকদের ভেঙ্গে পরার বড় কারণ, আর এই ভেঙ্গে পরাই মানুষকে যেকোন পথে
পা বাড়াতে সাহস যোগায় ।
3.গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিয়মিত ও স্থায়ী রেশনের আওতায় আনা যেতে
পারে ।
4.বিভিন্ন কোম্পানী শ্রমিকদেরকে দেশের আইন
ও বায়ারের চাহিদা অনুযায়ী প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা দিচ্ছেনা । কিন্তু তারা ডকুমেন্টারীভাবে
বায়ার ও সরকারকে ভুল বুঝাচ্ছে । যা শ্রমিকদের মাঝে অষন্তোষ হিসাবে কাজ করে এবং
ধীরে ধীরে একদিন তা বড় আকারে এলাকা থেকে শহর, আর শহর থেকে দেশে ছড়িয়ে পরে । তাই
সরকারকে একটি সত ও উচ্চপাযায়ের একটি টিম গঠন করতে হবে, যারা দেশের কারখানাগুলো
অডিট করবে এবং ভেতরের খবরাখবর বেড় করে সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সহযোগিতা
করবে । তবে সরকার চাইলে এই কাজে সোসাল কমপ্লাইয়েন্স এর অডিট ফামগুলোর সহযোগিতা
নিতে পারে । কারণ এই ফামগুলো যথেষ্ট কাযকরী, এবং তারা কারখানা ও শ্রমিকদের ভেতরের
খবরাখবর সম্পর্কে অবগত ।
5.শ্রমিকদের বিভিন্ন সুবিধা-অসুবিধা, দাবি-দাওয়া বা অসন্তোষ নিরসনের উদ্যোগে শুধু কারখানার বেতনভুক্ত কমকতাদের উপরে ছেড়ে না দিয়ে
সরাসরি মালিককে মনোনিবেশ করা উচিত, তাতে শ্রমিক ও মালিক উভয়েরই লাভ । আর এজন্য
যেকোন শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়ার আগে শ্রমিকদের উতপাদন ক্ষমতার সাথে প্রাপ্য
মজুরী সামঞ্জ কিনা? কারখানার বর্তমান প্রশাসনিক কার্যাবলী, কারখানার নিরাপত্তা
ব্যবস্থা, কর্মপরিবেশ এবং কারখানা পরিচালনায় মালিকদের সরাসরি ভূমিকা রাখতে হবে
।
6.বতমান প্রধান সমস্যা মূল্যস্ফীতি ও অযৌক্তিক বাড়িভাড়া বৃদ্ধি। যে হারে বাজার দর ও বাড়িভাড়াসহ জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে তাতে ঘন ঘন শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর দাবি করতে হচ্ছে। যা শ্রমিক
মালিক সম্পর্কে ফাটল ধরাচ্ছে । তাই সরকারকে বাড়ী ভাড়া নিয়ন্ত্রনের উপরে বিশেষভাবে
জোর দিতে হবে, বাড়ী-ভাড়া নিয়ে বর্তমান আইনকে আরো যুগোপযুগী করে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রন
করতে হবে ।
7. কারখানার কমপ্লায়েন্স আরো সঠিক পযায়ে
বাস্তবায়ন করতে হবে এবং শ্রমিকদের অধিকার, দায়িত্ব, কতব্য সম্পর্কে আরো সচেতন করতে
হবে । কারন একজন শ্রমিক যদি জানে সে তার মালিকের কাছে কতটুকু সুবিধা পাবে আর তার
বিনিময়ে তাকে কতকুটু শ্রম দিতে হবে, তাহলে সে আর মালিকের কাছে অযৌক্তিক দাবী-দাওয়া
করবেনা এবং মালিক-শ্রমিক সম্পকও নষ্ট হবেনা । এ ক্ষেত্রে মালিককে কারখানাগুলোতে
আরো ট্রেনিং, ভিডিও প্রদশন, বিনোদন এর ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে শ্রমিকদের সাথে
সুসম্পক বজায় থাকে ।
প্রতিবেশী প্রতিদ্বন্দ্বী :
চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম এবং দক্ষিণ আফ্রিকা পোশাক তৈরি ও রফতানি বাণিজ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এছাড়া নতুন করে মিয়ানমার তৈরি পোশাক শিল্পে বিনিয়োগের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে। তৈরি পোশাক রফতানি বাণিজ্যে মিয়ানমার এগিয়ে আসছে। গ্যাস-বিদ্যুত ও মানবসম্পদের সংকট না থাকায় এ শিল্পে মিয়ানমার খুব দ্রুত বিশ্ববাসীর নজর কাড়তে সক্ষম হবে। তাই আমাদের দেশের শ্রমিক ও সরকারকে উভয়েরই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে ।
যাদের আমাদের নিজেদের ভুল বোঝাবুঝির কারনে যেনো এই শিল্পকে হারাতে না হয় । তাই
বিষয়কে সামনে রেখে সরকারকে আরো কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রন করতে হবে এবং শ্রমিকদেরকেও আরো
নমনীয় ও সহানুভুতিশীল হতে হবে ।
মালিকদের কাছে শ্রমিকদের দাবী-দাওয়া
সারাজীবন ছিল, আর থাকবেও, এটাই স্বাভাবিক । কারণ শ্রমিকরাতো ওনার কারখানায়ই কাজ
করে, তাদের বতমান ও ভবিষ্যতের ভাল থাকার বীচতো এখানেই বোনা । তবে দাবী-দাওয়াগুলো
আদায়ের ক্ষেত্রে এতটা মাত্রাতিরিক্ত পযায়ে চাপ প্রয়োগ করা উচিত নয় যেন তার ব্যবসা
প্রতিষ্ঠানটি টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে দাড়ায় । তাই আমাদের বৃহত্তর স্বার্থে দুজন
দুজনের প্রতি সহনশীল হতে হবে ।
ইতিকথা :
বাংলাদেশে বস্ত্র ও পোশাক শিল্পের সম্ভাবনা আগামী ২০/৩০ বছরেও শেষ হবে না । পোশাক মানুষের মৌলিক চাহিদা । অর্থনীতির উত্থান-পতন যা-ই হোক না কেন, পোশাকের চাহিদা থাকবেই । আর আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছেও গুরুত্ব পাবে সাশ্রয়ী মূল্যে ভালো পোশাক পাওয়ার বিষয়টি । বাংলাদেশের মতো প্রতিযোগিতামূলক দামে ভালো মানের পোশাক আর কেউ দিতে পারবে না । পোশাক শিল্পে কলুষিত রাজনীতি বন্ধ করতে হবে, দুনীতি বন্ধ করতে হবে, শ্রম আইনের সঠিক ব্যবহার করতে হবে, বিদেশী বায়িং হাউসগুলোতে নিরাপত্তা বাড়ানোর পাশাপাশি বিদেশী বায়ারদের ব্যবসায়িক সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে, ব্যাংক লোনে সুদের হার কমাতে হবে, আর তাই দেশের এই অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাতের উন্নয়নে সরকারকে সকলের সহযোগিতা দরকার । কারণ বতমান সরকার গার্মেন্টস শিল্পকে যথেষ্ট
গুরুত্বের সাথে দেখে, তার নিরাপত্তায় যেকোন ব্যবস্থা গ্রহণে বদ্ধ পরিকর।
0 comments:
Post a Comment