দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই সত্যি যে এখনও আমাদের সংসার জীবনে যে সম্পর্ক গুলো নিয়ে সবচাইতে বেশী সমস্যা হয়, সেটি হলো বউয়ের সাথে শ্বশুরবাড়ির সম্পর্ক। এত আধুনিকতার পরেও এখনও আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বাড়ির বউদেরকে বিবেচনা করা হয় কেবলই বউ হিসেবে, একজন মানুষ নয়। বউ হিসেবে একটি মেয়ের ওপরে আচমকাই চাপিয়ে দেয়া হয় অগুনতি সম্পর্কের দায়, এবং সেসব পালনে একটু ত্রুটি বিচ্যুতি হলেই নিন্দার ঝড় বয়ে যায়। কেবল নিন্দা নয়, সাথে চলে নির্যাতন। শারীরিক – মানসিক- সামাজিক সকল প্রকারের নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয় বউদেরকে।
এবং সব চাইতে বড় কষ্টের ব্যাপার এটাই যে বউ হিসেবে একটি মেয়েকে যে সকল নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়, তার একটা বিশাল অংশই আসে তার শাশুড়ি-ননদ-ননাস ইত্যাদি সম্পর্কে যুক্ত আত্মীয় হতে। অর্থাৎ অপর একজন নারীর তরফ হতে।
-সকলেই ধরে নেয়, বউ হচ্ছে বউ। যত যাই হোক না কেন, তার কাজ শ্বশুর বাড়ির পছন্দ- অপছন্দ অনুযায়ী নিজেকে মানিয়ে নেয়া।
এটি খুবই ভুল একটি ধারণা, এমনকি রীতিমত নির্যাতনের সামিল।
শ্বশুর বাড়ির সকলেই ভুলে যায় যেই মেয়েটি তাদের বাড়ির বউ হয়ে এসেছে, সেও কারো বাড়ির কন্যা। এবং খুব আদরের কন্যা। এবং সর্বোপরি একজন মানুষ। তার আছে নিজস্ব কিছু চাওয়া–পাওয়া, পছন্দ-অপছন্দ। একটি সুন্দর সংসারের জন্য কেবল বউ মেয়েটি একলা মানিয়ে নেবার চেষ্টা করলে হবে না,বরং মানিয়ে চলতে হবে বাড়ির সবাইকেও। একটি মেয়ে তার আজন্ম চেনা ঘর ছেড়ে অন্য একটি বাসায় চলে এসেছে, আপন মানুষগুলিকে ছেড়ে এসেছে অচেনা মানুষদের ভিড়ে... একটু ভেবে দেখুন তো, কেমন হতে পারে তার মনের অবস্থা? এই পরিস্থিতিতে তার দিকে সাহায্য আর সহানুভূতির হাতই সকলের বাড়ানো উচিত, দায়িত্বের বোঝা নয়। সময়ের সাথে একবার নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে গেলে দায়িত্ব সে আপনা থেকেই বুঝে নেবে।
- একটা জিনিস মনে রাখবেন, চাপিয়ে দেয়া সম্পর্ক কখনোই ভালবাসা অর্জন করতে পারে না। কিংবা সম্মান পায়না। হতে পারে আপনার বাড়ির ছেলের সাথে বৈবাহিক সূত্রে একটি মেয়ে আপনাদের বাড়ির বউ, এবং তার ফলে আপনি তার শাশুড়ি-শ্বশুর-ভাসুর-দেবর-ননদ-ননাস কিংবা অন্য কেউ। কিন্তু একটা কাগজের সই আসলে সম্পর্ক তৈরি করতে পারে না। নতুন সদস্যের সাথে যদি আপনি সম্পর্ক তৈরি করতে চান, কিংবা হয়ে উঠতে চান বউটির শাশুড়ি-শ্বশুর-ভাসুর-দেবর-ননদ-ননাস... তাহলে প্রথম হাতটা বাড়াতে হবে আপনাকেই। সম্পর্ক তৈরি হলে, তবেই না রক্ষা করার প্রশ্ন। যদি কাগজের সম্পর্ক জ্বর করে চাপিয়ে দিয়ে ভালবাসা অর্জন করতে চান, তবে ভালবাসা- সম্মান কিছুই মিলবে না জীবনে।
- শাশুড়ি আম্মাদেরকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে আপনার বউটিও কোনও মায়ের কন্যা। আপনার পুত্র যেমন আপনার আদরের, এই মেয়েটিও তার মায়ের আদরের সন্তান। একজন মা হিশাবে বউকে আপন করে নেবার, তাকে ভালবাসা দেবার প্রথম দায়িত্ব অবশ্যই আপনার। আপনি বয়সে বড়, সম্পর্কে বড়, জীবনের পথে অভিজ্ঞতা বেশী। ভালবাসা- স্নেহ- মমতার সেতু তৈরির প্রথম পদক্ষেপ তাই আপনাকেই নিতে হবে।
- অনেক বাড়িতে বিয়ের পর পড়েই বউদেরকে ঠেলে দেয়া হয় রান্নাঘরে। এটা খুবই অনুচিত। নতুন বিয়ের পরে এমনিতেই নব দম্পতিকে একটু ছাড় দেয়া উচিত পরস্পরের সাথে মানিয়ে নেয়ার জন্য। বিয়ে মানে তো কেবল রাতের বেলা একসাথে থাকা নয়, বিয়ে মানে আরও অনেক অনেক অনেক কিছু। এটা ছাড়াও নতুন একটি মেয়েকে হুট করে রান্নাঘরে ঠেলে না দিয়ে তাকে মানিয়ে নেবার সুযোগ দিন। এই সংসারটি যে তার আপন, সব কিছুর অপরেই তার অধিকার আছে ইত্যাদি ব্যাপার গুলো তাকে অনুধাবন করার সুযোগ দিন।
- বউ কেবল সংসার সামলানোর যন্ত্র কিংবা উত্তরসূরি জন্ম দেয়ার মাধ্যম নয়, সেই মেয়েটি অতি অবশ্যই একজন সম্পূর্ণ মানুষ। তার নিজের একটা জীবন আছে, কিছু স্বপ্ন আছে। তাই নিজেদের স্বপ্ন মানুষটির ওপরে চাপিয়ে দিবেন না। অনেক পরিবারেই বাচ্চা নেয়ার জন্য, বা বউদের চাকরি- বাকরি করা নিয়ে ভীষণ সমস্যা তৈরি হয়। যা কিনা খুবই অনুচিত।
- পরিবারের নতুন মানুষটির সাথে ভালো ব্যবহার করুন, পান থেকে চুল খসলেই তাকে দুটো কথা শুনিয়ে দেবার বাসনা ত্যাগ করুন। সে তো আর সংসার জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞ নয়, পুরো ব্যাপারটাই আর কাছে নতুন। ভুলত্রুটি হতেই পারে, আর সেটাই স্বাভাবিক। ভুল হলে তাতে পৃথিবী অশুদ্ধ হয়ে যায় না।
- কারো কাছে বউদের নিন্দা করবেন না। বউ নিন্দনীয় কাজ করলেও না। তাতে যে কেবল সম্পর্ক কেবল খারাপ হয়, তা নয়। বরং আপনার সম্মানও ক্ষুণ্ণ হয় বাইরের লোকের সামনে।
একজন মেয়ে, যে কিনা নিজের বাবা- মা- ভাই- বোনকে ছেড়ে চলে এসেছে আপনাদের সংসারে আর নিয়ে এসেছে ভবিষ্যতের অনেক সুন্দর স্বপ্ন... সেই মেয়েটির মন না ভাঙ্গার দায়িত্ব কিন্তু আপনরাই। ভালবাসা দিয়ে জয় করা সম্ভব পৃথিবীর যে কোনও কিছু। বাড়িয়ে দিন ভালবাসার হাত, স্পর্শ দিন স্নেহের। দেখবেন সকলে মিলেমিশে আপনাদের সংসারটা হয়ে উঠেছে চির শান্তির নীড়।
0 comments:
Post a Comment