ইসলামে নারীর যৌন অধিকার

islamic-women.jpg 
 ইসলামের সমালোচকরা অনেকে বুঝাতে চান যে, ইসলামে নারীদের যৌন চাহিদার কোনো মূল্য নেই, বরং এই ব্যাপারে পুরুষকে একতরফা অধিকার দেওয়া হয়েছে, পুরুষ যখন ইচ্ছা তখন যৌন চাহিদা পূরণ করবে আর স্ত্রী সেই চাহিদা পূরণের জন্য সদা প্রস্তুত থাকবে। এ ধারণার পেছনে কুরআন ও হাদিসের অসম্পূর্ণ পাঠের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। বস্তুত কুরআনের কিছু আয়াত বা কিছু হাদিস দেখে কোনো বিষয় সম্পর্কে ইসলামের শিক্ষাকে পুরোপুরি উপলব্ধি করা সম্ভব নয়, বরং তা অনেক ক্ষেত্রেই পাঠককে বিভ্রান্ত করতে পারে। কোনো বিষয় সম্পর্কে ইসলামের শিক্ষাকে সঠিকভাবে উপলদ্ধি করতে হলে সেই সংক্রান্ত কুরআনের সবগুলো আয়াত এবং সবগুলো হাদিসকে সামনে রাখতে হবে। যা হোক, এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য শুধু এতটুকু দেখানো- ইসলামে নারীদের যৌন চাহিদার কোনো স্বীকৃতি আছে কি-না। এবার আসুন মূল আলোচনায়।
কেন এই দাবি : সূরা বাকারার ২২৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের স্ত্রীরা হলো তোমাদের জন্য শস্য ক্ষেত্র। তোমরা যেভাবে ইচ্ছা তাদেরকে ব্যবহার কর।’

হঠাৎ করে এই আয়াতাংশ কারো সামনে পেশ করা হলে মনে হতে পারে যে, এখানে পুরুষকে যখন ইচ্ছা তখন তার স্ত্রীর সঙ্গে যৌনাচার অবাধ অনুমতি দেওয়া হচ্ছে, এমনকি স্ত্রীর সুবিধা-অসুবিধার দিকেও তাকানোর কোনো প্রয়োজন যেন নেই।

যারা এ ধারণার প্রচারণা চালান তারা সাধারণত এই আয়াতটি উল্লেখ করার পর তাদের ধারণার সমর্থনে কিছু হাদিসও উপস্থাপন করেন।

মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘কোনো স্ত্রী যদি তার স্বামীর বিছানা পরিহার করে রাত কাটায় তবে ফেরেশতারা সকাল পর্যন্ত তাকে অভিশাপ দিতে থাকে।’ (মুসলিম)

উপরোক্ত আয়াতাংশ এবং এই ধরণের কিছু হাদিস পেশ করে অনেকই এটা প্রমাণ করতে চান যে, ইসলাম কেবল পুরুষের যৌন অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করেছে এবং নারীকে যৌন মেশিন হিসেবে যখন তখন ব্যবহারের ফ্রি লাইসেন্স দিয়ে রেখেছে। সোজা কথায় ইসলামে যৌন অধিকার যেন একতরফাভাবে পুরুষের। আসলেই কি তাই?

উপরোক্ত আয়াত সংক্রান্ত বিভ্রান্তির নিরসন : মদিনার ইহুদিদের মধ্যে একটা কুসংস্কার এই ছিল যে, কেউ যদি তার স্ত্রীর সঙ্গে পেছন দিক থেকে যোনিপথে সঙ্গম করত তবে বিশ্বাস করা হতো যে, এর ফলে ট্যারা চোখবিশিষ্ট সন্তানের জন্ম হবে। মদিনার আনসাররা ইসলামপূর্ব যুগে ইহুদিদের দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত ছিল। ফলে আনসারাও এই কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিলেন। মক্কাবাসীদের ভেতর এই কুসংস্কার ছিল না। মক্কার মুহাজিররা হিজরত করে মদিনায় আসার পর, জনৈক মুহাজির যখন তার আনসার স্ত্রীর সঙ্গে পেছন দিক থেকে সঙ্গম করতে গেলেন, তখন এক বিপত্তি দেখা দিল। আনসার স্ত্রী এই পদ্ধতিকে ভুল মনে করে জানিয়ে দিলেন রাসুল (সা.) এর অনুমতি ব্যতিত এই কাজ তিনি কিছুতেই করবেন না। ফলে ঘটনাটি রাসুল (সা.) পর্যন্ত পৌঁছে গেল।

এ প্রসঙ্গেই কুরআনের উপরোক্ত আয়াতটি নাযিল হয়, যেখানে বুঝানো হচ্ছে,  সামনে বা পেছনে যেদিক দিয়েই যোনিপথে গমন করা হোক না কেন, তাতে কোনো সমস্যা নেই। শস্যক্ষেত্রে যেদিক দিয়ে বা যেভাবেই গমন করা হোক না কেন তাতে শস্য উৎদনে যেমন কোনো সমস্যা হয় না, তেমনি স্বামী তার স্ত্রীর যোনিপথে যেদিক দিয়েই গমন করুক না কেন তাতে সন্তান উৎপাদনে কোনো সমস্যা হয় না এবং এর সঙ্গে ট্যারা চোখবিশিষ্ট সন্তান হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে, পায়ুপথে গমন (Anal Sex) করা হারাম।

কাজেই এই আয়াতের উদ্দেশ্য ইহুদিদের প্রচারিত একটি কুসংস্কারের মূলোৎপাটন, স্ত্রীর সুবিধা অসুবিধার প্রতি লক্ষ্য না রেখে যখন তখন অবাধ যৌনাচারের অনুমোদন নয়।

ফেরেশতাদের অভিশাপ সংক্রান্ত হাদিসটির বিশ্লেষণ : এবার ফেরেশতাদের অভিশাপ করা সংক্রান্ত ওপরের হাদিসটার কথায় আসি। এই হাদিসটা বুখারিতেও এসেছে আরেকটু পূর্ণরূপে এভাবে- যদি কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে বিছানায় ডাকে (যেমন- সঙ্গম করার জন্য), আর সে প্রত্যাখান করে ও তাকে রাগান্বিত অবস্থায় ঘুমাতে বাধ্য করে, ফেরেশতারা সকাল পর্যন্ত তাকে অভিশাপ করতে থাকে।

একটু ভালো করে লক্ষ্য করুন, স্ত্রী স্বামীর ডাকে সাড়া না দেওয়ায় স্বামী রাগান্বিত হয়ে কী করছে? স্ত্রীর ওপর জোর-জবরদস্তি করে নিজের যৌন অধিকার আদায় করে নিচ্ছে? নাকি ঘুমিয়ে পড়েছে?

এই হাদিসে নারী কর্তৃক স্বামীর ডাকে সাড়া না দেওয়ার কারণে স্ত্রীর সমালোচনা করা হলেও পুরুষকে কিন্তু জোর-জবরদস্তি করে নিজ অধিকার আদায়ে উৎসাহিত করা হচ্ছে না। আবার স্ত্রী যদি অসুস্থতা বা অন্য কোনো সঙ্গত ওজরের কারণে যৌনাচার হতে বিরত থাকতে চান, তবে তিনি কিছুতেই এই সমালোচনার যোগ্য হবেন না, কেননা ইসলামের একটি সর্বস্বীকৃত নীতি হচ্ছে, ‘আল্লাহপাক কারো ওপর তার সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপান না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৮৬)

ইসলাম কি শুধু নারীকেই সতর্ক করেছে? : এটা ঠিক যে, ইসলাম স্ত্রীদেরকে স্বামীর যৌন চাহিদার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছে, কিন্তু স্বামীকে নিজ চাহিদা আদায়ের ব্যাপারে উগ্র হওয়ার কোনো অনুমতি যেমন দেয়নি তেমনি স্বামীকেও স্ত্রীর যৌন চাহিদার প্রতি যত্মবান হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। ইসলাম স্ত্রীকে বলেছে, যদি রান্নরত অবস্থায়ও স্বামী যৌন প্রয়োজনে ডাকে তবে সে যেন সাড়া দেয়, অন্য দিকে পুরুষকে বলেছে, সে যেন তার স্ত্রীর সঙ্গে ভালো আচরণ করে, স্ত্রীর কাছে ভালো সাব্যস্ত না হলে সে কিছুতেই পূর্ণ ঈমানদার বা ভালো লোক হতে পারবে না।

এই কথা জানার পরও কোনো পুরুষ কি স্ত্রীর সুবিধার প্রতি কোনোরূপ লক্ষ্য না রেখেই যখন তখন তাকে যৌন প্রয়োজনে ডাকবে? ইসলাম পুরুষকে এব্যাপারেও সাবধান করে দিয়েছে যে, নিজের যৌন চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে স্ত্রীর যৌন চাহিদার কথাকে সে যেন ভুলে না যায়।

অনেকে হয়ত ভাবছেন, কী সব কথা বলছি, কোথায় আছে এসব?

ইসলামে স্ত্রীর সঙ্গে সদাচরণের গুরুত্ব

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ঈমানওয়ালাদের মধ্যে পরিপূর্ণ মুমিন সেই ব্যক্তি, যার আচার-আচরণ উত্তম। আর তোমাদের মাঝে তারাই উত্তম যারা আচার-আচরণে তাদের স্ত্রীদের কাছে উত্তম।’ (তিরমিযি, হাদিস নং : ১০৭৯)

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, আরেকটি হাদিস, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, মুমিন-মুমিনার প্রতি বিদ্বেষ রাখবে না। যদি তার একটি অভ্যাস অপছন্দনীয় হয় তবে আরেকটি অভ্যাস তো পছন্দনীয় হবে।’ (মুসলিম, হাদিস নং:  ১৪৬৯, ২৬৭২)

হযরত আয়িশা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ঈমানওয়ালাদের মধ্যে পরিপূর্ণ মুমিন সেই ব্যক্তি যার আচার-আচরণ উত্তম এবং নিজ পরিবারের জন্য অনুগ্রহশীল।’ (তিরমিযি, হাদিস নং: ২৫৫৫)

তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে, মুমিন পুরুষ তার মুমিনা স্ত্রীর প্রতি বিদ্বেষ রাখতে পারবে না। সদাচারী এবং স্ত্রী-পরিবারের প্রতি কোমল, নম্র, অনুগ্রহশীল হওয়া ঈমানের পূর্ণতার শর্ত। কোনো পুরুষ যদি উত্তম হতে চায় তাকে অবশ্যই তার স্ত্রীর কাছে উত্তম হতে হবে।

একজন মুসলিমের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয় সেটা হচ্ছে, তার ঈমান,  যে ঈমানের জন্য সে নিজের প্রাণ বিসর্জন করতেও কুন্ঠিত হয় না, সেই ঈমানের পরিপূর্ণতার জন্য স্ত্রীর সঙ্গে সদাচারী, নমনীয় এবং অনুগ্রহশীল হওয়া ছাড়া উপায় নেই। কোনো মুসলিম উত্তম বলে বিবেচিত হতেই পারবে না যদি না স্ত্রীর সঙ্গে তার আচার-আচরণ উত্তম হয়।

এখন প্রশ্ন হলো, যে স্বামী তার স্ত্রীর যৌন চাহিদার প্রতি কোনো লক্ষ্য রাখে না, সে কি তার স্ত্রীর কাছে উত্তম হতে পারে? অথবা যে স্বামী তার স্ত্রীর সুবিধা অসুবিধার প্রতি লক্ষ্য না রেখে যখন তখন তার স্ত্রীর সঙ্গে যৌনকার্যে লিপ্ত হয় সে কি তার স্ত্রীর কাছে উত্তম হতে পারে?

এর সহজ উত্তর হচ্ছে, পারে না। একজন ভালো মুসলিম যেমন স্ত্রীর জৈবিক চাহিদার প্রতি যত্নবান হবে, তেমনি নিজের জৈবিক চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে এমন অবস্থার সৃষ্টিও করবে না যা তার স্ত্রীর জন্য কষ্টকর হয়। স্ত্রীর প্রতি অসদাচরণ করে কেউ তার স্ত্রীর কাছে ভালো হতে পারে না আর পরিপূর্ণ মুমিনও হতে পারে না।

ইসলামে স্ত্রীর যৌন চাহিদার প্রতি গুরত্ব : ইসলাম নারীর যৌন অধিকারকে শুধু স্বীকৃতিই দেয় না বরং এ ব্যাপারে কতটুকু সচেতন নিচের হাদিসটি তার একটি প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

হযরত আনাস বিন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, ‘যখন পুরুষ তার স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করে তখন সে যেন পরিপূর্ণভাবে (সহবাস) করে। আর তার যখন চাহিদা পূরণ হয়ে যায় (শুক্রস্খলন হয়) অথচ স্ত্রীর চাহিদা অপূর্ণ থাকে, তখন সে যেন তাড়াহুড়া না করে।’ (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদিস নং : ১০৪৬৮)

কী বলা হচ্ছে এখানে? সহবাসকালে পুরুষ তার নিজের যৌন চাহিদা পুরো হওয়া মাত্রই যেন উঠে না যায়, স্ত্রীর যৌন চাহিদা পূরণ হওয়া পর্যন্ত যেন বিলম্ব করে।  এরকম একটা হাদিস চোখ দিয়ে দেখার পরও কারো জন্য এমন দাবি করা কি ঠিক হবে যে, ইসলামে নারীদের যৌন চাহিদার কোনো স্বীকৃতি নেই।

এসব তো গেল উপদেশ। কিন্তু বাস্তবে কেউ যদি এসব উপদেশ অনুসরণ না করে তাহলে এই ধরণের পুরুষদের সতর্ক করা তার অভিভাবক এবং বন্ধুদের যেমন দায়িত্ব তেমনি স্ত্রীরাও তাদের স্বামিদের বিরূদ্ধে ইসলামি রাষ্ট্রের কাছে নালিশ করার অধিকার রাখে।

এছাড়া সঙ্গমকালে স্ত্রীকে যৌনভাবে উত্তেজিত না করে সঙ্গম করাকে ইসলামে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা তাতে স্বামীর চাহিদা পূরণ হলেও স্ত্রীর চাহিদা পূরণ হয় না এবং স্ত্রীর জন্য তা কষ্টকর হয়।

আমরা কিছু দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা নিয়ে আলোচনা করবো যেখানে স্ত্রীর যৌন অধিকারের প্রতি অবহেলা করার কারণে স্বামীকে সতর্ক করা হয়েছে, এমনকি স্বামীর বিরূদ্ধে ইসলামি শাসকের কাছে নালিশ পর্যন্ত করা হয়েছে।

হযরত আবু মুসা আশয়ারী (রা.) থেকে বর্ণিত, হযরত ওসমান ইবনে মাযউন (রা.) এর স্ত্রী মলিন বদন এবং পুরাতন কাপড়ে নবী করিম (সা.) এর বিবিদের কাছে এলেন। তারা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার এই অবস্থা কেন? কুরাইশদের মাঝে তোমার স্বামী থেকে ধনী কেউ নেই। তিনি বললেন, এতে আমাদের কি হবে? কেননা আমার স্বামীর রাত নামাযে কাটে ও দিন রোযায় কাটে। তারপর নবী করিম (সা.) প্রবেশ করলেন। তখন নবীজীর স্ত্রীগণ বিষয়টি তাকে বললেন। অতঃপর হযরত ওসমান ইবনে মাযউন (রা.) এর সঙ্গে সাক্ষাত হলে তিনি তাকে বললেন, ‘আমার মধ্যে কি তোমার জন্য কোনো আদর্শ নাই?’ হযরত ওসমান (রা.) বললেন, ‘কী বলেন ইয়া রাসুলুল্লাহ? আমার বাবা-মা আপনার জন্য উৎসর্গিত! তখন তিনি বললেন, ‘তবে কি তোমার রাত নামাযে আর দিন রোযায় কাটে না? অথচ তোমার উপর তোমার পরিবারের হক রয়েছে, আর তোমার উপর তোমার শরীরেও হক রয়েছে, তুমি নামাযও পড়বে, আবার ঘুমাবেও, আর রোযাও রাখবে আবার ভাঙ্গবেও।’ তিনি বললেন তারপর আরেকদিন তার স্ত্রী পরিচ্ছন্ন ও সুগন্ধিত অবস্থায় এলেন যেন নববধূ। (মাজমায়ে জাওয়ায়েদ, হাদিস নং : ৭৬১২, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং-৩১৬)

হযরত আবু জুহাইফা (রা.) বলেন, নবী (সা.) সালমান (রা.) এবং আবু দারদা (রা.) এর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন স্থাপন করেছিলেন। সালমান (রা.) আবু দারদা (রা.) এর সঙ্গে সাক্ষাত করতে গেলেন আর উম্মে দারদা (রা.) [আবু দারদা (রা.)এর স্ত্রী]-কে ময়লা কাপড় পরিহিত অবস্থায় দেখতে পেলেন এবং তাকে তার ওই অবস্থার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি বললেন, ‘আপনার ভাই আবু দারদার দুনিয়ার চাহিদা নাই।’ এর মধ্যে আবু দারদা এলেন এবং তার (সালমানের) জন্য খাবার তৈরি করলেন আর বললেন, ‘খাবার গ্রহণ করো কারণ আমি রোযা আছি।’  সালমান (রা.) বললেন, ‘তুমি না খেলে আমি খাচ্ছি না।’ কাজেই আবু দারদা (রা.) খেলেন। যখন রাত হলো, আবু দারদা (রা.) উঠে পড়লেন (রাতের নামায পড়ার জন্য)। সালমান (রা.) বললেন, ‘ঘুমাও’ তিনি ঘুমালেন। পুনরায় আবু দারদা উঠলেন (নামাযের জন্য), আর সালমান (রা.) বললেন, ‘ঘুমাও’। রাতের শেষ দিকে সালমান (রা.) তাকে বললেন, ‘এখন ওঠো (নামাযের জন্য)’। কাজেই তারা উভয়ে নামায পড়লেন এবং সালমান (রা.) আবু দারদা (রা.) কে বললেন, ‘তোমার ওপর তোমার রবের হক রয়েছে, তোমার ওপরে তোমার আত্মার হক রয়েছে, তোমার ওপর তোমার পরিবারের হক রয়েছে, কাজেই প্রত্যেককে তার প্রাপ্য হক প্রদান করা উচিত।’ পরে আবু দারদা (রা.) নবী (সা.) এর সঙ্গে সাক্ষাত করলেন এবং একথা তার কাছে উল্লেখ করলেন। নবী (সা.) বললেন, ‘সালমান সত্য বলেছে।’ (বুখারি, হাদিস নং : ১৮৬৭)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, ‘আমার বাবা একজন কুরাইশি মেয়ের সঙ্গে আমাকে বিয়ে করিয়ে দিলেন। ওই মেয়ে আমার ঘরে আসল। আমি নামায রোযা ইত্যাদি এবাদতের প্রতি আমার বিশেষ আসক্তির দরুণ তার প্রতি কোনো প্রকার মনোযোগ দিলাম না। একদিন আমার বাবা আমর ইবনে আস (রা.) তার পুত্রবধূর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার স্বামীকে কেমন পেয়েছ? সে জবাব দিল, খুবই ভালো লোক অথবা বললো খুবই ভালো স্বামী। সে আমার মনের কোনো খোঁজ নেয় না এবং আমার বিছানার কাছেও আসে না। এটা শুনে তিনি আমাকে খুবই গালাগাল দিলেন ও কঠোর কথা বললেন এবং বললেন, আমি তোমাকে একজন কুরাইশি উচ্চ বংশীয়া মেয়ে বিয়ে করিয়েছি আর তুমি তাকে এরূপ ঝুলিয়ে রাখলে? তিনি নবী করিম (সা.) এর কাছে গিয়ে আমার বিরূদ্ধে নালিশ করলেন। তিনি আমাকে ডাকালেন। আমি উপস্থিত হলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি দিনভর রোযা রাখ? আমি বললাম হ্যাঁ। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি রাতভর নামায পড়? আমি বললাম হ্যাঁ। তিনি বললেন, কিন্তু আমি রোযা রাখি ও রোযা ছাড়ি, নামায পড়ি ও ঘুমাই, স্ত্রীদের সঙ্গে মেলামেশা করি। যে ব্যক্তি আমার সুন্নতের প্রতি আগ্রহ রাখে না সে আমার দলভুক্ত না।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং :  ৬৪৪১)

হযরত কাতাদাহ (রহ.) বলেন, ‘একজন নারী উমর (রা.)-এর কাছে এসে বললেন, আমার স্বামী রাতভর নামায পড়েন এবং দিনভর রোযা রাখেন। তিনি বললেন, তবে কি তুমি বলতে চাও যে, আমি তাকে রাতে নামায পড়তে ও দিনে রোযা রাখতে নিষেধ করি? নারীটি চলে গেলেন। তারপর আবার এসে পূর্বের ন্যায় বললেন। তিনিও পূর্বের মতো উত্তর দিলেন। হযরত কাব বিন সূর (রহ.) বললেন, আমিরুল মুমিনিন, তার হক রয়েছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কীরূপ হক? কাব (রহ.) বললেন, কাব (রহ.) বললেন, আল্লাহ তাআলা তার জন্য চার বিবাহ হালাল করেছেন। সুতরাং তাকে চারজনের একজন হিসেব করে প্রত্যেক চার রাতের এক রাত তার জন্য নির্ধারিত করে দিন। আর প্রত্যেক চার দিনের একদিন তাকে দান করুন। উমর (রা.) তার স্বামীকে ডেকে বলে দিলেন যে, প্রতি চার রাতের একরাত তার কাছে যাপন করবে এবং প্রতি চারদিনের একদিন রোযা পরিত্যাগ করবে।’ (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদিস নং : ১২৫৮৮)

ইসলামে অন্তরঙ্গতা সৃষ্টির গুরুত্ব : ইসলাম সঙ্গমের পূর্বে স্ত্রীর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা সৃষ্টি বা শৃঙ্গার করার প্রতি যথেষ্ঠ গুরুত্ব আরোপ করে। স্ত্রীর যৌনাঙ্গকে সঙ্গমের জন্য প্রস্তুত না করেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়াকে- যা স্ত্রীর জন্য অত্যন্ত কষ্টকর- ইসলামে ‘পশুর ন্যায় সঙ্গম করা’বলে অভিহিত করা হয়েছে এবং সঙ্গমের আগে শৃঙ্গার এবং আবেগপূর্ণ চুম্বন করাকে সুন্নাতে মু্‌ওয়াক্কাদাহ বলা হয়েছে।

হযরত আনাস বিন মালিক (রা.) হতে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কেউ যেন পশুর মতো তার স্ত্রী হতে নিজের যৌন চাহিদাকে পূরণ না করে, বরং তাদের মধ্যে চুম্বন এবং কথাবার্তার দ্বারা শৃঙ্গার হওয়া উচিত।’ (দাইলামির মুসনাদ আল-ফিরদাউস)

ইমাম ইবনুল কাউয়্যিম (রহ.) তার বিখ্যাত গৃন্থ ‘তিব্বে নববী’তে উল্লেখ করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) শৃঙ্গার করার আগে সঙ্গম করতে নিষেধ করেছেন।’ (তিব্বে নববী, পৃষ্ঠা : ১৮৩)

আল্লামা আল-মুনাবি (রহ.) বলেন, ‘সঙ্গমের আগে শৃঙ্গার এবং আবেগপূর্ণ চুম্বন করা সুন্নাতে মু্‌ওয়াক্কাদাহ এবং এর অন্যথা করা মাকরূহ।’ (ফাইজ আল-ক্বাদির, ৫/১১৫, দ্রষ্টব্য: হাদিস নং : ৬৫৩৬)

শেষ কথা, শুরুতেই বলেছি, আমার এই লেখার উদ্দেশ্য শুধু এতটুকু দেখানো ইসলামে নারীদের যৌন চাহিদার কোনো স্বীকৃতি আছে কি-না। কাজেই ইচ্ছা করেই কুরআন এবং হাদিসের উল্লেখযোগ্য অনেক কিছুই এখানে যোগ করি নাই। কিন্তু যতটুকু উল্লেখ করেছি তা জানার পরও ‘ইসলামে নারীদের যৌন চাহিদার কোনো মূল্য নেই’, ‘ইসলামে পুরুষকে স্ত্রীর ওপর যথেচ্ছ যৌনাচারের ফ্রি লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে’, ‘ইসলামে যৌন অধিকার একতরফাভাবে পুরুষকে দেওয়া হয়েছে’এই জাতীয় অভিযোগ সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন কেউ কি করবে? তথ্যসূত্র : সদালাপ

0 comments:

Post a Comment

" কিছু স্বপ্ন আকাশের দূর নীলিমাক ছুয়ে যায়, কিছু স্বপ্ন অজানা দূরদিগন্তে হারায়, কিছু স্বপ্ন সাগরের উত্তাল ঢেউ-এ ভেসে যায়, আর কিছু স্বপ্ন বুকের ঘহিনে কেদে বেড়ায়, তবুও কি স্বপ্ন দেখা থেমে যায় ? " সবার স্বপ্নগুলো সত্যি হোক এই শুভো প্রার্থনা!