পণ্য নয় কণে, মানুষ হও...


ঘটনা ১

যা শুনবেনঃ
“হঠাৎ করেই বিয়েটা হয়ে গেলোরে। দু’সপ্তাহ পর পরীক্ষা, তাতে কি! মেয়ে যদি হাতছাড়া হয়ে যায় তাই আক্দটা করিয়ে দিলো। না না, আগে থেকে কিছুই ঠিক ছিলনা, এমনি কথাবার্তা চলছিল আর কি। দেখতে এসেই পছন্দ হয়ে গেলো আমাকে তাই...। না ও আজকে ঢাকায় ফিরল, গত দুইদিন আমাদের বাসাতেই ছিল। অনেক ঘুরেছি দুইজন বিয়ের পরে, জানিস? সরি, কাউকে জানাতে পারিনি... হ্যাঁ, হীরের আংটি দিয়েছে। এই দ্যাখ... না না, আংটি ঐদিনই দোকানে গিয়ে কিনেছে।... আমি অনেক হ্যাপি রে। ও আমার অনেক কেয়ার করে। আর আমার পড়াশুনা নিয়ে অনেক চিন্তা করে। খালি পড়তে বলে। বলে, সামনে পরীক্ষা, পড় পড়। ”
যে প্রশ্ন তাকে ভদ্রতার বশে করবেন নাঃ
পড়াশোনা নিয়ে তোর জামাইয়ের এতই চিন্তা যখন তখন তোর পরীক্ষার ঠিক আগে আগে বিয়ে করলো কেন?
যা হয়তো কখনো জানতে পারবেন নাঃ
শুধু পরীক্ষার প্রাক্বালে বিয়ে পড়ানোয় নয়, আরও অনেক কিছুতেই নতুন বউয়ের উপর জোর খাটিয়েছে জামাই। অনেক কিছু মানে “অনেক কিছুই”।
তবে এই কাহিনী গুলো আপনি কখনও জানবেন না। এই কাহিনীগুলো নবদম্পত্তির ঘরের চার দেয়ালের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকবে। 

ঘটনা ২ 

যা শুনবেনঃ
"মেয়েটা যা বেহায়া! একটা ডিভোর্সের পরও আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসছে! আবার ধুমধাম করে অনুষ্ঠানও করছেন আহমদ সাহেব! ডিভোর্সের কাহিনী জানেন না? ওই যে, ছেলে নাকি ড্রিঙ্ক করে, পরনারীতে আসক্তি আছে, বৌ কিছু বলতে গেলে নাকি বৌ পেটায়। আরে জামাইকে আটকে রাখার দায়িত্ব তো বউয়েরই। বৌ যদি আটকে রাখতে না পারে, ছেলে তো অন্য মেয়ের দিকে ঝুঁকবেই। একজনের সাথে ডিভোর্স তো হলই, এখন আবার আরেক ছেলেকে বিয়ে করে তার জীবন নষ্ট করবে বেহায়াটা। নাহ, দেশটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে ভাবী।”

যে প্রশ্ন ভদ্রতার বশে করবেন নাঃ
“এই একই কাজ যদি মেয়েটা করত? ড্রিঙ্ক করত, অন্য ছেলের সাথে ঘুরত, তাহলে কি ওর স্বামী তাকে ছেড়ে কথা বলতো ভাবী?”
যে কথা হয়তো কখনো শুনবেন নাঃ

দুইটা বিয়েই মেয়ের নিজের পছন্দে। প্রথমবার বড্ড ভুল করেছিল আসলে, বিয়ের পরপরই সে বুঝতে পেরেছিল যে ভালোবেসে নয় বরং বাবার অঢেল সম্পত্তির লোভে ছেলেটি তাকে বিয়ে করেছে । তবুও লাথি-জুতো খেয়ে ৫ বছর সংসার করেছে, দুই ছেলেমেয়ের মা হয়েছে কিন্তু কোনও সম্মান পায়নি। শেষমেশ স্বামী যখন দ্বিতীয় একটা মেয়েকে বিয়ে ছাড়াই বাড়িতে এনে তুলল, ডিভোর্সটা না দিয়ে পারা গেলো না। এখন তার দ্বিতীয় বিয়ে- এ বিয়েতে মেয়ে লজ্জিত নয়, গর্বিত। দ্বিতীয় যে ছেলেটিকে সে বিয়ে করতে যাচ্ছে সে শুধু ভালোই বাসে না, শ্রদ্ধাও করে। সত্যি সত্যি সম্মান দেয়। মেয়ের বিশ্বাস নতুন জীবনে সে অনেক সুখী হবে। 

কি, ঘটনাগুলো খুব পরিচিত মনে হচ্ছে? এমন ঘটনার কোনও অভাব নেই আমাদের দেশে। আপনার পরিবার, পাড়া -প্রতিবেশী কিংবা বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেই আরও ভুরি ভুরি উদাহরণ খুঁজে পাবেন। আমাদের চোখের মনেই ঘটছে এসব, নিজের হাতেই হয়তো আমরা নিজেদের কিংবা বোন-কন্যাকে বানাচ্ছি পণ্য। বিপনীবিতানে যেভাবে মেনিকুইনদের সাজিয়ে রাখা হয়, তেমনি সাজিয়েগুজিয়ে মেয়েকে হাতে ট্রে ধরিয়ে দিয়ে বরপক্ষের সামনে উপস্থাপন করি আমরা। বরপক্ষ যা চায় সে মতন মেয়েকে গড়ে-পিঠে দেই। শাশুড়ি যদি চান তাহলে স্কার্ফ পড়তে অভ্যস্ত মেয়েকে স্কার্ফ ছাড়তে বলি, আবার শাশুড়ি যদি গোঁড়া হন তাহলে মেয়েকে পর্দাশীল বানাতে চেষ্টার কমতি করিনা। মেয়ে কোথায় চাকরি করবে, নাকি করবেই না তা ছেড়ে দিই শ্বশুরবাড়ির ইচ্ছে অনিচ্ছের ওপর। নিজের ছেলের বিয়ে দিতে হলে তা দেই ছেলে প্রতিষ্ঠিত হওয়ারও বছর দুই পর, কিন্তু সেই ছেলের জন্যই খুঁজি এইচ এস সি পাস কিংবা বড়জোর অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ুয়া বৌ। 

“মেয়েরা তাড়াতাড়ি ম্যাচিউর হয়ে যায়” এই অজুহাত তুলে বিয়েটা দেই ঠিকই কিন্তু ম্যাচিউর মেয়েদের যে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেবার অধিকার থাকতে পারে সে চিন্তা করি না। আর এই মেয়েগুলো যখন মেকাপে সজ্জিত হয়ে বরের আলিঙ্গনবদ্ধ হয়ে প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারের দিকে তাকিয়ে হাসিহাসি মুখে পোজ দেয়, কান্না কান্না গলায় আমরা, ছেলে বা মেয়েপক্ষ যেটাই হই, বলি, “মেয়েটা বড় হয়ে গেলো।” কিন্তু আসলেই কি মেয়েটা বড় হয়েছে নাকি আমরাই তাদের বড় করে দিচ্ছি? তার মেকাপের আড়ালে ঢেকে যাওয়া কষ্টের দাগ কেন আমরা দেখতে পাচ্ছি না? শুধুই যে পারবারিক পছন্দের বিয়ের ক্ষেত্রে এমন অবস্থা , তা কিন্তু নয়। বিয়ে যদি মেয়ের নিজের পছন্দেও হয় তাহলেও দেখা যায় বিবাহপূর্ব কিংবা পরবর্তী সময়ে কোনও না কোন ভাবে তাকে বলি হতে হয় অন্যের ইচ্ছা-অনিচ্ছার, নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার জন্য লড়াই করতে হয় আপন মানুষগুলোর সাথেই। 

প্রশ্নটা হচ্ছেঃ এমনটা কেন? ভালো পাত্রের গুণাবলী হিসেবে দেখা হয় তার শিক্ষাগত ও পেশাগত যোগ্যতা। আর ভালো পাত্রীর গুনাবলির মধ্যে এগুলোর অবস্থান নিচের দিকে। ভালো পাত্রী সেই যে কিনা দারুণ ফর্সা, কিংবা দেখতে সুন্দরী। ভালো রাঁধে-বাড়ে, ঘরসজ্জায় নিপুণ- অর্থাৎ একেবারে বসার ঘরের শোকেসের পুতুলটি এবং পরিবারের সবকাজ করে দেবার গেরস্থালী রোবটটির অপূর্ব সংমিশ্রণ। কিন্তু মনুষ্যত্ব? মানবিকতাবোধ? সততা, ন্যায়নীতি, ভদ্রতা? এগুলো কি ওই দুই পাতার বায়োডাটাতে লেখা থাকে? কিংবা পারস্পরিক বোঝাপড়া হবে কি না ছেলে-মেয়ে দুজনের, একজনের মনমানসিকতা অপরজনের সাথে মানিয়ে যাবে কি না, একে অপরকে সত্যিকার অর্থে সম্মান করতে পারবে কি না বিয়ের (অ্যারেঞ্জ কিংবা লাভ যে ম্যারেজই হোক) সিদ্ধান্ত নেবার আগে এগুলো ভালো করে ভেবে দেখে কয়জন? হ্যাঁ, বয়োজ্যেষ্ঠরা এ প্রশ্নের উত্তরে একটা মোক্ষম অস্ত্র ছাড়বেন, “মানুষকে কি কখনও সম্পূর্ণ বোঝা যায়? ২০ বছরের সংসারও ভেঙ্গে যেতে দেখেছি কত... তাহলে বিয়ের আগে কয়েকদিন কথা বলে কিই বা বুঝবে একে অপরকে ওরা?” কিন্তু এর মানে তো এও নয় যে সাঁতার না জানা সত্ত্বেও আমরা চোখ বন্ধ করে পানিতে ঝাঁপ দেব... একবার চোখ খুলে পানির গভীরতা বুঝবার চেষ্টাটুকুও করবো না! 

হ্যাঁ, সে চেষ্টা এদেশের বেশিরভাগ মেয়েই করে না বলেই তারা হয়তো ভুল কাউকে বিয়ে করে (ভালোবেসেই হোক কিংবা পরিবারের পছন্দেই হোক) আর সংসার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে প্রতিটি পদক্ষেপে সব সমঝোতার ভার নিজের কাঁধেই চাপিয়ে নেয়। আর এভাবেই নিজেদের পণ্যে রূপান্তরিত করে চলে মেয়েরা নিজেরাই।

কিন্তু এভাবে আর কতদিন? এ প্রশ্ন করবার সময় এসেছে। আপনি, আমি, আমরা জীবনে এরকম বহুবার হয়ত নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বিসর্জন দিয়েছি, কোনও কোনও ক্ষেত্রে নারী জাগরণের ব্যাপারে দেখিয়েছি স্ববিরোধিতা। সভা-সেমিনারে যে নারীনেত্রী নারী জাগরণ নিয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা ঝেড়েছেন, তিনিই হয়তো বাসায় ফিরে বউমার রান্নায় লবন-মরিচের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বাপের বাড়ির কথা তুলে মুখ ঝামটা দিতে পিছপা হননি। অল্পবয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় যে মা নিজে পড়াশুনা শেষ করতে পারেননি বলে অনেক চোখের জল ঝরিয়েছেন, পড়াশুনার মাঝখানে নিজের মেয়ের বিয়ে দেয়াতে রেজাল্ট খারাপ আসায় মেয়ের উপর সেই মা নারাজ হননি, রেজাল্ট যেমনই হোক, জামাই তো ভালো পেয়েছে মেয়ে আমার! যে বোনটি পরিবারের কারণে নিজের পছন্দের ছেলেটিকে বিয়ে করতে পারে নি, সেই মেয়েটিই আবার তার ছোট বোনের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করাকে সমর্থন করেনি। যে মহিলাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে খুব নামী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, তারই বর যখন দ্বিতীয় বিয়ে করে ছোট বউকে একই বাড়িতে এনে তুলে তখন পতিব্রতা নারীর মতো সেই মহিলা দ্বিতীয় মেয়েটির সাথে সই পাতায়, দুই বোন হয়ে থাকে, স্বামীর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য। যে মেয়েটি বাড়ি বাড়ি কাজ করে কষ্ট করে উপার্জন করে, সেই উপার্জনের টাকায় মদ গিলে স্বামী যখন বাসায় ফিরে বৌ পেটায় মেয়েটি নীরবে সহ্য করে। 

হ্যাঁ, আমরা মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে যেন। নিজে মেয়ে হয়ে পাশের বাড়ির ভাবীর ডিভোর্স নিয়ে মুখরোচক গল্প ফাঁদতে আত্মতৃপ্তি লাভ করি আমরা। হায়রে নারী! নারী শিক্ষার হার নাকি বেড়েছে অনেক! এই বুঝি শিক্ষার হার? এই বুঝি নারী জাগরণ? চোখ খুললেই ঘুম ভাঙ্গেনা, আগে ঘুম ভাঙতে হবে মনের। আমরা মেয়েরা লেখাপড়া শিখছি, চাকরি করছি, ঘর সামলাচ্ছি সবই করছি কিন্তু এগিয়ে যেতে পারছি না। কারণ আমাদের মন-মস্তিষ্ক-আত্মসম্মানবোধ আজো ঘুমিয়ে। এর জেগে ওঠার জন্য শুধু শিক্ষা নয়, আরেকটা জিনিসের প্রয়োজন। আর সেটা হল গভীর আত্মোপলব্ধি। 

তাই বলি, দিনের শত কাজের মধ্যে যদি এতটুকু সময় পান, অন্তত একবার নিজেকে নিয়ে ভাবুন। নিজের ব্যক্তিত্ব, নিজের ইচ্ছে- অনিচ্ছে-স্বপ্ন-লক্ষ্য-ভালো লাগা-মন্দ লাগা নিয়ে ভাবুন। একটা বার নিজেকে মানুষ ভাবতে শিখুন, পণ্য বা পুতুল নয়।

0 comments:

Post a Comment

" কিছু স্বপ্ন আকাশের দূর নীলিমাক ছুয়ে যায়, কিছু স্বপ্ন অজানা দূরদিগন্তে হারায়, কিছু স্বপ্ন সাগরের উত্তাল ঢেউ-এ ভেসে যায়, আর কিছু স্বপ্ন বুকের ঘহিনে কেদে বেড়ায়, তবুও কি স্বপ্ন দেখা থেমে যায় ? " সবার স্বপ্নগুলো সত্যি হোক এই শুভো প্রার্থনা!