সন্তান যখন একটি

"আমার একটিই বাচ্চা"...আজকাল এই কথাটি খুবই শোনা যায়। বলা যায় আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় যেসব আমূল পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে তাদের মাঝে অন্যতম হলো বেশিরভাগ পরিবারেই একটি, খুব বেশি হলে দুইটি সন্তান। যে পরিবারে দুইটি সন্তান থাকছে, তাদের নিয়ে তেমন একটা চিন্তার কারন থাকে না। মা-বাবা, ভাই–বোন মিলে মিশে নিজেদের আলাদা জগতে সুন্দর করেই তাদের দিনগুলো কেটে যায়। যদি কথা ওঠে বড় পরিবার মানে যৌথ পরিবারের কথা, তবে এবিষয়ে এখন আর তেমন কোন কথা চলে না। কারন সত্যি কথাটা হল সেই যুগ আর নেই। খুব অল্প কিছু যৌথপরিবার এখনও এই ইট-কাঠের শহরে টিকে থাকলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইচ্ছে থাকলেও বৃহৎ পরিবারের একত্রিত ভালবাসা পাওয়া এখন একটি কঠিন স্বপ্ন। ঘুরে ফিরে সবাই তাই একক পরিবারে জীবন যাপনে বাধ্য।

একক পরিবারে ক্ষতিও কিছু নেই। তবে প্রশ্ন ওঠে তখনই, যখন কিনা একটি একক পরিবারের সন্তানও হয় কেবল একজন। মা-বাবার আদরের সাথে ভাইবোনহীন একাকীত্ব নিয়ে আসলে সে কেমন দিন কাটায়? একা বেড়ে ওঠার নিঃসঙ্গতা কি সে অনুভব করে? না কি সে ভাবতে শিখেছে এটাই স্বাভাবিক? সে কি একলা থাকতেই ভালোবাসে?

বিষয়টি জটিল হলেও একটু ভেবে দেখবার মত। তবে ভাবনার চাইতেও যেটা বেশি জরুরি তা হলো সন্তানের প্রতি আপনার আচরণ এবং সঠিক নির্দেশনা। সাধারনত দেখা যায়,একটি বাচ্চা মানেই আদুরে ধন। পরিবার, আত্মীয়স্বজন সকলের সে চোখের মনি। সে যা বলে,যা চায়,তাই তার সামনে হাজির। এতে দোষের কিছুই নেই,বরং এটাই স্বাভাবিক। আদরের একমাত্র সন্তান আপনার ,তার বায়না মানে এ যেন আপনার ভালোবাসার পরীক্ষা। কিন্তু এত কিছুর পরেও সে প্রশ্ন করতেই পারে- আমার ভাই নেই কেন? বোন নেই কেন? আর বাবা মায়ের আসল পরীক্ষাটাই এখানেই।
একটু ছোট থাকতে বাচ্চারা নিজের ভাই-বোন না থাকা না থাকার পার্থক্য বুঝতে পারে না। কিন্তু একটু বড় হলে আস্তে আস্তে সে আবিষ্কার করতে শুরু করে যে সে একা, কিন্তু পাশের বাড়ির বন্ধু বন্ধুদের হয়তো ফুটফুটে একটা ভাই অথবা বোন আছে। ওদের কি মজা, দুইজনে মিলে কত খেলতে পারে। এক সাথে স্কুলে যায়,ইসস্‌! আমার কেন ভাই-বোন নেই। কিন্তু মা-বাবা হিসেবে একটু আগে থেকেই যদি আপনি নিজে এই ব্যাপারে সতর্ক থাকেন, দেখবেন অনেকটাই সহজ হবে এই বিষয়টি সামলে নেয়া।
নিঃসঙ্গ পরিবেশে একাকী বড় হওয়া বাচ্চারা অনেক সময়েই অতিরিক্ত জেদী হিসাবে বেড়ে ওঠে। অনেক সময়েই তারা বিষণ্ণতায় ভোগে বা নিজেকে খুব একলা ভেবে ভেবে বড় হতে থাকে। অনেকেই মিশুক হয়ে উঠতে পারে না বা কারো সাথে সহজভাবে মিশতে পারে না। পরবর্তীতে এইসব বাচ্চারা সম্মুখীন হয় নানান রকম মানসিক সমস্যার। অনেকের মাঝেই গড়ে ওঠে না "শেয়ার" করার মানসিকতা। ব্যাপারটা এমন নয় যে আপনাকে ওর সাথে বসে এটা নিয়ে খুব সিরিয়াসলি কথা বলতে হবে। সেটা সম্ভবও নয় এবং প্রয়োজনীয়ও নয়। বাচ্চাকে বড় করে তোলার প্রক্রিয়াটির মাধ্যমেই এমন কিছু কাজ করে যেতে হবে, যাতে ভাই বোন না থাকার বিষয়টি সে সহজ ভাবে নিতে পারে। আবার অন্যদিকে তাঁর মানসিক বিকাশও যেন বাধাগ্রস্থ না হয়।
  • -প্রথম থেকেই সন্তানকে বুঝতে দিন এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। একা থাকা মানে ওকেই আপনি সবচাইতে বেশি ভালবাসেন, সবচাইতে ভালো ভাবে ওর খেয়াল রাখতে চান। পৃথিবীতে সবারই অনেক ভাই বোন থাকে না, ওর মতন অনেকেই আছে একমাত্র সন্তান।
  • -কেবল নিজের ভাইবোনই আপন, অন্য কেউ নয়- এই ধারণা বদলে ফেলুন। বাচ্চাকে বোঝান যে ওর অন্য কাজিনরাও তার ভাই-বোন। খালাত, মামাতো,চাচাতো, ফুপাতো-এদের সবার সাথে ওর পর্যাপ্ত যোগাযোগের সুযোগ রাখুন। সময় পেলেই ওকে কাছের-দুরের আত্মীয়দের সাথে মেশার সুযোগ করে দিন। একা হলেও ওর পরিবার কত বড়,ওকে আদর করার কত মানুষ আছে তাদেরকে চেনার সুযোগ করে দিন।

- হয়তো আরও সন্তান চান, কিন্তু কোনও কারণে হচ্ছে না বা হবে না। এইসব ক্ষেত্রে কখনোই এক সন্তানের সামনে হা হুতাশ করবেন না আরেকটি সন্তানের জন্য। এতে সে মনে করবে বাবা মা তাকে ভালোবাসে না বলেই আরেকটি সন্তান চান।

  • -একটু বড় হলে ওকে বুঝতে দিন আপনারা, মানে ওর মা-বাবা দিনরাত পরিস্রম করছেন শুধুই ওর জন্য। ভাই-বোন মানেই বাড়তি দায়িত্ব,অন্য কেউ নিতে পারলেও আপনাদের পক্ষে সেই দায়িত্ব নেয়া সম্ভব নয়। অন্য কারোর প্রতি সময় দিলে ওর জন্য হয়তো এতটা সময় পাওয়া যাবে না।
  • -বিষয়টা একান্তই নিজেদের ব্যক্তিগত। অন্য কাউকে এই নিয়ে কথা বলার সুযোগ না দেয়াটাই ভালো। যদি আলাপ করতেই হয়, চেষ্টা করুন যেন বাচ্চা সামনে না থাকে। অবশ্যই খেয়াল রাখুন এইসব আলাপ যেন কোনভাবেই আপনার বাচ্চার সামনে না হয়।
  • - এখন যা বলবো এটাই সবচাইতে সাধারণ সমস্যা, এবং সাধারনত এটাই বাচ্চাকে এই ধরনের বিষয় নিয়ে ভাবতে উৎসাহিত করে। উৎসাহী লোকেরা আপনার সন্তানের সামনে যখন বলবে ওর একটা ভাই দরকার, কিংবা ওকে একটা বোন এনে দাও, সেদিন থেকেই ও ভাবতে শুরু করবে আমার ভাই/বোন নেই কেন? দিনের শেষে সে আপনাকেই প্রশ্ন করবে। তখন ব্যাপার গুলো তাকে বুঝিয়ে বলুন যে সকলেরই ভাই বোন থাকবে এমন কোনও নিয়ম নেই।
  • -কখনোই বলতে দেবেন না যে তার ভাই-বোন নেই। সব সময় সব কাজিনদের কথা মনে করিয়ে বলুন যে ওর কত ভাই-বোন।
  • স্কুলের ছুটি-ছাটার ফাঁকে ওর কাজিনদের বাসায় নিয়ে যান, ফোনে আলাপ করিয়ে দিন রেগুলার। পরিবারের সবাই মিলেওর বড় ভাই-বোনদের সাথে একসাথে নানাবাড়ি-দাদাবাড়ি বেড়ানোর আসুন। এতে সবার সাথে ওর বোঝাপড়াটা ভাল হবে। দরকার পরলে ও বুঝতে পারবে কার কাছে যাবে, সাহায্য নেবে। নিজেকে কখনও একা ভাববে না ।
  • -সব চাইতে জরুরি হল আপনি নিজে ওকে যথেষ্ট সময় দিচ্ছেন তো? সব কিছু দিয়ে রেখেও যদি বাচ্চা নিজের বাবা-মাকে ঠিক মতন কাছে না পায়,তাহলে কোনো লাভ নেই। এই একাকীত্ব কেউই দূর করতে পারবে না ।আবার সময় মানে শুধু "কোয়ান্টিটি" নয়, এখানে "কোয়ালিটির" বিষয়টাই মুখ্য। ওর সাথে সারাদিন কাটিয়েও ওকে বুঝতে না পারা, অন্যদিকে সপ্তাহের শেষে ছুটির দিনের দুই ঘণ্টার একসাথে সুন্দরসময় কাটানোর মাঝে শেষেরটাই বেশি দরকারি।
  • - অভিভাবকেদের মাঝে কোনও একজন যদি কিছু একটা কারণে বাচ্চার জন্য সময় বের করতে না পারেন, তাহলে অপর জনকে হতে হবে আরও বেশী মনযোগী।
  • - বাচ্চার ভাই বোন নেই, সে একলা থাকে... এইসব ভেবে বাচ্চাকে অতিরিক্ত খেলনা বা অতিরিক্ত আহ্লাদ- কোনটাই দিবেন না। আপনার আরও কয়েকটি সন্তান থাকলে যেভাবে মানুষ করতেন, সেই একইভাবে মানুষ করুন। অতিরিক্ত সব কিছুই ক্ষতিকর।
  • -বাচ্চার দাদা-দাদী, নানা-নানীরা একি সাথে বসবাস করাটা খুব চমৎকার একটা বিষয়। তাতে আর বাচ্চারা নিজেদের একলা ভাবতে পারে না। দাদা-দাদী, নানা-নানীরাই হয়ে ওঠে তাদের বন্ধু।

এই লেখাটি একান্তই তাদের জন্য যারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নিজেদের সুবিধা এবং পছন্দমত একটি সন্তান নিয়ে বাকিটা জীবন কাটানোর। মানুষের জীবন বিচিত্র, তার চাইতেও বেশি বর্ণিল। পারিবারিক,সামাজিক প্রেক্ষাপটের আর বহুদিনের পুরনো প্রথার বিরুদ্ধে নেয়া আপনাদের এই সিদ্ধান্তকে এখনও নানা রকমের পথ পাড়ি দিতে হয়, কিন্তু এর প্রভাব পরে আপনার আদরের সন্তানটির উপর। এমন একটি জটিল বিষয় তাই ওর মানসিকতার সাথে তাল মিলিয়ে,ওর মতন করেই আপনাকে বোঝাতে হবে।

0 comments:

Post a Comment

" কিছু স্বপ্ন আকাশের দূর নীলিমাক ছুয়ে যায়, কিছু স্বপ্ন অজানা দূরদিগন্তে হারায়, কিছু স্বপ্ন সাগরের উত্তাল ঢেউ-এ ভেসে যায়, আর কিছু স্বপ্ন বুকের ঘহিনে কেদে বেড়ায়, তবুও কি স্বপ্ন দেখা থেমে যায় ? " সবার স্বপ্নগুলো সত্যি হোক এই শুভো প্রার্থনা!