তারুণ্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হলো বন্ধুত্ব। একে অপরের সাথে বন্ধুত্বের মাধ্যমেই অতি সাধারণ মানুষ একতাবদ্ধ হয়ে ঘটিয়ে দেয় অসাধারণ সব বিপ্লব। কিন্তু এই বন্ধুত্বের মাঝে বর্তমানে যে বিশাল ফাটল দেখা দিয়েছে তা কি আমরা কেউ লক্ষ্য করছি? আর এই ফাটলের আকার দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। আর এর পেছনে কারণ? ফেসবুক।
শুনে হয়তো অনেকের চোখ কপালে উঠবে। কারণ ফেসবুক নাকি দূরের বন্ধুকে কাছে নিয়ে আসছে, বন্ধুর পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। অনেকেই গর্ব করে বলবেন তাদের ফেসবুকে কয়েকশো এমনকি কয়েক হাজার বন্ধু। কিন্তু এই “বন্ধু” দের সাথে আপনার বন্ধুত্বের মাত্রাটা কতটা খাঁটি? এমনকি এদের মাঝে কতজন আপনার শুভানুধ্যায়ী? এদের কতজনকে আসলেই চেনেন আপনি আর কতজনকেই বা “অফলাইনে” অথবা বাস্তব জীবনে চেনেন আপনি? এমনটাও হতে পারে, আপনি যাকে মেয়ে ভেবে সমানে চ্যাট করে যাচ্ছেন সে ই হয়তো একটি ছেলে। নিজের পরিচয় গোপন রাখা যায় বলে অনলাইনে মানুষ যেমন ইচ্ছে তেমন করে নিজের নকল পরিচয় তৈরি করে নিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে মিথ্যের ওপর গড়ে ওঠা যে সম্পর্ক তাকে বন্ধুত্বের তকমা লাগিয়ে “বন্ধু” শব্দের অবমাননাই করা হচ্ছে না কি?
আর শুধু বন্ধুত্বই নয়। ফেসবুকের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আমাদের মনস্তত্ত্বের ওপরেও। উটাহ ভ্যালি ইউনিভার্সিটির সমাজতত্ত্ববিদেরা ৪০০ কলেজ শিক্ষার্থীর ওপরে গবেষণা চালিয়ে গবেষকরা আরও সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, যেসব মানুষ বেশিরভাগ সময় ফেসবুকে বসে কাটায় তারা নিজেদের জীবনের ব্যাপারে বেশি হতাশ। এর কারণ হলো, ফেইসবুকে নিজেদের বন্ধুদেরকে দেখে মনে হয় তারা খুব ভালো সময় কাটাচ্ছে যদিও বাস্তবে তাদের পরিস্থিতি একই রকম। এ থেকে জন্ম নিচ্ছে নিজের জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা এবং হতাশা আর বন্ধুদের প্রতি তৈরি হচ্ছে ঈর্ষার অনুভূতি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ফেসবুকে একটি পোস্টে যদি দেখা যায় কোনও একজন ব্যক্তির সব বন্ধুরা একসাথে আড্ডা দিচ্ছে অথচ তাকে আমন্ত্রন করেনি, তবে মনে ক্ষোভ জাগতেই পারে। বন্ধুত্বের জন্য এহেন ঈর্ষা বা ক্ষোভ কোনটাই কাম্য নয়।
বন্ধুত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ এবং অনেকাংশে ব্যক্তিগত বিষয়টিকে অনলাইনে নিয়ে এসেছি আমরা। বন্ধুদের সাথে কথাবার্তা বলার সময় অনেক ক্ষেত্রেই আমরা আবেগপ্রবণ হয়ে পরই এবং এমন আচরণ করি যেটা বন্ধু ছাড়া অন্য কেউ দেখলে আমাদের ভুল বুঝতে পারে। বাস্তব জীবনে এমন ব্যাপারগুলো ব্যক্তিগতভাবেই আমরা সমাধান করে ফেলতে পারি। কিন্তু ফেসবুকে এই পুরো বিষয়টাই চলে আসে সবার সামনে। দেখা যায় এমন একটি পোস্টে আপনি নিজের বন্ধুর সাথে কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে গেলেন যেটা সবাই দেখতে পাচ্ছে। অথবা নিজের বন্ধুর ওপর রাগ করে তাকে কটাক্ষ করে একটি স্ট্যাটাস দিলেন আপনি। এমন অবস্থায় অন্যরা এখানে নাক গলাবে এবং পক্ষ নিয়ে কথা বলবে। এতে আপনাদের দুজনের মাঝে বন্ধুত্বের অবনতিই হবে। আবার দেখুন, আপনি অনেক সময়ে একেবারেই নির্দোষ একটি স্ট্যাটাস দিলেন (যেমন পছন্দের গানের কয়েকটি কলি) কিন্তু আপনার ফ্রেন্ড লিস্টের কিছু কিছু মানুষ মনে করতে পারে এটি আপনি লিখেছে সেই বন্ধুটিকে উদ্দেশ্য করে যার সাথে আপনার বনিবনা হচ্ছে না। এমন অবস্থায় খুবই বাজে রকমের ড্রামা তৈরি হয়ে যেতে পারে যেটা বাস্তব জীবনে হবার সম্ভাবনা কম।
ফেসবুক অথব এমন যে কোনও সামাজিক সাইটের সবচাইতে বড় সমস্যা হলো যোগাযোগের মাধ্যম। আপনি বন্ধুবান্ধবের সাথে বাস্তবে কথা বলতে যতটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, চ্যাট করার সময়ে কি তেমনটাই হয়? কথোপকথনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হলো কথা বলার সুর বা ধরণ। একই কথা বিভিন্ন ভাবে বললে অনুভূতিটি আলাদা হয় এবং মনোভাবেরও পরিবর্তন হয়ে যায়। কিন্তু ফেসবুকে চ্যাটের সময়ে যতই ইমটিকোন বা স্টিকার ব্যবহার করুন না কেন, ঠিক কি ভাবে কথা বলছেন আপনি, তা হয়তো আপনার বন্ধুটি কিছুতেই বুঝতে পারছে না। এর ফলে সৃষ্টি হয় বিভ্রান্তি আর ভুল বোঝাবুঝি।
ফেসবুকের বিপক্ষে এত কথা শুনে মনে করবেন না যেন ফেসবুক পুরোই একটা শয়তানের আখড়া! মানুষের বৈশিষ্ট্য এটাই যে তাকে কোনও একটি যন্ত্র দেওয়া হলে সে ওটাকে ভালো কাজেও ব্যবহার করতে পারে বা খারাপ কাজেও ব্যবহার করতে পারে। ফেসবুকও তেমনই একটি যন্ত্র। আমরা যদি একে ঠিকভাবে ব্যবহার করি তবে আমাদের বাস্তব জীবনের বন্ধুত্ব নষ্ট করার বদলে তা আরও গভীর করে তুলতে পারবে। ল্যাপটপটি একটু বন্ধ করে বন্ধুটির বাড়িতে বেড়াতে যান এবং সামনাসামনি কথা বলুন, দেখবেন কত ভালো লাগছে! ফেসবুকের নতুন নতুন অপরিচিত বন্ধুর পেছনে সময় দিতে গিয়ে আমরা বাস্তব জীবনের অনেক কাছের বন্ধুদের যেন অবহেলা না করি- এই দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের নিজেদেরই এবং তাহলেই আবারও বন্ধুত্বের শক্তি প্রতিষ্ঠিত হবে আমাদের সমাজে।
0 comments:
Post a Comment