পুরনো দিনে আমাদের দেশের সব বাড়িতে এবং বিদ্যালয়ে একটি নির্দিষ্ট “সংস্কৃতি” চর্চা করা হত, আর তা হল পিতামাতা কর্তৃক সন্তানকে বেধড়ক পেটানো। এখন আমাদের কাছে এটা শুনতেও পৈশাচিক লাগে, কিন্তু একসময় মারতে মারতে ছেলেমেয়ের শরীরে দাগ ফেলে দেওয়াটা ছিল বাবামায়ের কাছে দৈনন্দিন রুটিন। বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে তো ছাত্রদের “পিটিয়ে মানুষ করা” কাজটি ছিল পবিত্র! এর ফলে বাচ্চাদের যে কি পরিমাণ মনস্তাত্ত্বিক চাপে থাকতে হতো এটা চিন্তা করার অবকাশ ছিল না তাদের। বর্তমানেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে এ ঘটনাটি ঘটতে দেখা যায় না, তা কিন্তু নয়। তবে সৌভাগ্যের ব্যাপার এই যে এখন এর পরিমাণ অনেকটাই কমে এসেছে। তবে শারীরিক নির্যাতন কমে এলেও মানসিক দিক দিয়ে কিন্তু তারা এখনও ক্রমাগত চাপের সম্মুখীন। বিশেষ করে তরুণ সন্তানের ওপর কোনও কারণে অসন্তুষ্ট হলে বাবা মায়েরা এখন বেত দিয়ে না মারলেও, কটুবাক্যের ভারে জর্জরিত করে ফেলছেন তাকে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে শাস্তি হিসেবে এটা তো যথেষ্টই হালকা। কিন্তু তা সত্যি নয় মোটেই! বরং বৈজ্ঞানিকরা রীতিমত গবেষণা করে জানতে পেরেছেন যে বাচ্চাদেরকে বকা দেওয়া এবং মারার অভ্যাসের ফলাফল হয় একই।
শাস্তি হিসেবে বাচ্চাদেরকে মারলে যে রকম ক্ষতি হয়, তাদের সাথে উচ্চ স্বরে এবং রুঢ়ভাবে কথা বললে বা বকাঝকা করলেও একই রকমের ফলাফল হবে- ইউনিভার্সিটি অফ পিটসবার্গ এবং ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগানের গবেষকদের যৌথ গবেষণার তথ্য থেকে জানা যায়। Child Development জার্নালে প্রকাশিত হয় এই গবেষণার ফলাফল।
উন্নত বিশ্বে এমনকি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বর্তমানে বাচ্চাদের গায়ে হাত তোলাকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হলেও বাচ্চাকে বকাঝকা করার ক্ষেত্রে নেই এমন কোনও বিধিনিষেধ। অভিভাবকেরা মনে করেন যে বকাঝকা করলে বাচ্চারা কথা শুনে চলবে, ভালো আচরণ করবে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় তার উল্টোটা। “তিরস্কারের মাধ্যমে তাদের খারাপ আচরণ কমানো বা সংশোধন করা যায় না, বরং এতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে ওঠে”, বলেন মিং টে ওয়াং, ইউনিভার্সিটি অফ পিটসবার্গ এর একজন সহকারী অধ্যাপক।
টিমোথি ভারডুইন নামের একজন মনস্তত্ত্ববিদ বলেন, সন্তানের আচরণ সংশোধন করার জন্য তাদের কিছু বিশেষ সুবিধা কমিয়ে দেওয়া যেতে পারে। যেমন তাদের টিভি দেখার সময় কিংবা হাতখরচ কিছুদিনের জন্য কমিয়ে দেওয়া, বন্ধুদের সাথে আড্ডাবাজির সময়টা সাময়িক কমানো ইত্যাদি। তবে এই কাজটি করতে হবে কোনও সমালোচনামূলক, শাস্তিমূলক বা অপমানজনক কথাবার্তা বাদ দিয়ে”, তিনি বলেন। “বাচ্চারা যাকে সম্মান করে এবং প্রশংসা করে তার কথা তারা বেশি মেনে চলে। আপনি যদি তাকে তিরস্কার করেন অথবা অপমান করেন তাহলে আপনার প্রতি তার এই সম্মান ক্ষুণ্ণ হবে”।
এই গবেষণায় ৯৭৬টি পরিবার পর্যবেক্ষণ করা হয় যাতে ১৩-১৪ বছর বয়সী সন্তান রয়েছে। একটি জরিপে গবেষকরা এসব তরুণদেরকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন তাদের আচরণগত সমস্যা, বিষণ্ণতার উপসর্গ এবং অভিভাবকদের সাথে তাদের সম্পর্কের ধরণ নির্ধারণ করতে। অভিভাবকদের ওপরেও জরিপ করা হয় বাচ্চাদের সাথে তারা কি রকম আচরণ করেন এবং তাদেরকে সুশৃঙ্খল করে তোলার জন্য কি মাত্রায় বকাঝকা করেন তা নির্ধারণের জন্য।
দেখা যায়, ১৩ বছর বয়সী বাচ্চাদের প্রায় ৪৫ ভাগ মা এবং ৪২ ভাগ বাবা স্বীকার করেন যে তারা গত এক বছরের মাঝে তাদের সন্তানের আচরণ সংশোধনের জন্য তাদেরকে বেশ রুঢ়ভাবে বকাঝকা করেছেন। এসব তরুণদের ক্ষেত্রে দেখা যায় পরবর্তী বছরে তাদের আচরণের সমস্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মাঝে রয়েছে সমবয়সীদের সাথে মারামারি করার প্রবণতা, স্কুলের নিয়ম অমান্য করা এবং বাবা মায়ের কাছে মিথ্যে বলা। এর সাথে সাথে তাদের মাঝে বিষণ্ণতার মাত্রাও বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়। আর যেসব ক্ষেত্রে বাবামায়েরা বকা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের শরীরে হাত তুলেছেন, সেসব ক্ষেত্রেও একই ভাবে তরুণদের এসব সমস্যার উৎপত্তি হতে দেখা যায়। বাবা মায়ের সাথে ভালো সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও তারা যখন বকাঝকা করছেন তখন তাদের তরুণ সন্তানটির মনে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঠিকই পড়ছে।
আর তরুণদের মনের ওপরে কেন এত খারাপ প্রভাব ফেলে অভিভাবকের তিরস্কার? এর কারণ হলো, বয়ঃসন্ধিকালে তারা নিজেদের একটা পরিচয় গড়ে তোলা শুরু করে। এ সময় অভিভাবকের তিরস্কারের ফলে তাদের মনে হয় তারা যথেষ্ট যোগ্য নয় এবং নিজেদেরকে অযোগ্য, অক্ষম মনে করা থেকেই উৎপত্তি হয় তাদের খারাপ আচরণের প্রবণতা এবং বাবামায়ের তিরস্কার অগ্রাহ্য করে তারা হয়ে ওঠে বেপরোয়া।
0 comments:
Post a Comment