ভালবাসার কোনও বয়স নেই সত্যি, তবে তারুণ্যের ভালবাসার আছে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি অর্থ। কৈশোরের ভালো লাগালাগি পেরিয়ে তারুণ্যতে পা দিতেই স্পর্শ করে যায় মিষ্টি প্রেম, একটু একটু করে মিলেমিশে যেতে শুরু করে জীবনের সাথে। কেউ স্বীকার করুক আর নাই করুক, আমাদের বেশিরভাগের জীবনেই প্রথম প্রেমটা হয় এই তারুণ্যেই। সবার চোখ লুকিয়ে, অজানা শিহরনের আনন্দে দোলা সেই প্রেমের মাধুর্য আসলেই অন্যরকম। মিষ্টি ভালবাসার বাক্য, অনাগত ভবিষ্যতের স্বপ্ন, একটু টক-ঝাল খুনসুটি... সদ্য তারুণ্যে এটাই তো প্রেম, নাকি?
প্রেমে... বড় বেশি চোখ রাঙানি আমাদের সমাজে এই প্রেমকে নিয়ে। আর সেই প্রেম যদি হয় তারুণ্যে, তাহলে তো আরও বেশী। হাজারো বিধি নিষেধের শেকলে বেঁধে দেয়া হয় তারুণ্যের উচ্ছলতাকে তখন। তবে তাতে কি? প্রেম কখন বিধিনিষেধ শুনেছে না মেনেছে? মন কি আর শেকলে বাঁধা যায়! ভালো লাগা আসে, আস্তে আস্তে দূরত্ব কমে, একসময় দুটি মন বাঁধা পড়ে যায় একই বন্ধনে। আর তারুণ্যে তো প্রেম হয় লাগামছাড়া, বাঁধনহারা, উচ্ছল, উদ্দাম, প্রাণবন্ত... ঠিক যেন তারুণ্যের মতই!
তবে সত্যি বলতে কি, বিপদটা কিন্তু সেখানেই। উদ্দাম-উচ্ছল সম্পর্কে ভুল করে ফেলার সম্ভাবনা যেমন অনেক বেশি, তেমনি বেশি নিজের জীবনের কোনও স্থায়ী ক্ষতি করে ফেলার। কম বয়সের ভীষণ আবেগে ভুল হতেই পারে, আর সেটাই স্বাভাবিক। আর সেই কারণেই হয়ত মা- বাবার শাসন, ভাই বোনের উপদেশ ইত্যাদি কখনো পিছু ছাড়ে না তারুণ্যের প্রেমে। তবে ভুলে গেলে চলবে না যে তাঁরা আমাদের আপনজন, আর মঙ্গল কামনা করেন বলেই কি শাসনটা করে থাকেন। আপনজনের এই শাসনকে ঋণাত্মক দৃষ্টিতে না দেখে বরং দেখা উচিত সহজ ভাবে, এবং সম্পর্কের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা উচিত নিজেদেরও।
প্রেম আসবেই, প্রেমের আগমনকে তো আর ঠেকিয়ে রাখা জীবনে। আর সেটা উচিতও নয়। তবে তারুণ্যের প্রেম বলেই বেহিসেবী হওয়া চলবে না কিছুতেই, বরং আবেগের জোয়ারে ভাসার পাশাপাশি লক্ষ্য রাখতে হবে আরও কিছু বিষয়েও। তাতে পছন্দের মানুষের সাথে আপনার সম্পর্ক যেমন থাকবে সুন্দর, তেমনি পারিবারিক জীবন বা কেরিয়ারেও কোনও ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে না। কেমন? আসুন জেনে নেই সেসব নিয়েই কিছু কথা।
- ভালো লাগা থেকে ভালবাসা আসতেই পারে, তবে কাউকে ভালো লাগলে অবশ্যই তার ব্যাপারে একটু বিস্তারিত জেনে নেবার চেষ্টা করবেন। আজকাল প্রেমের ফাঁদে ফেলে নানান রকম অপরাধ সংগঠনের হার বেড়েছে খুব। তবে তার পাশাপাশি এটাও জরুরী যে পছন্দের পাত্র ও তার পরিবার সম্পর্কে একেবারে না জেনেই সম্পর্কে জড়ানোটা খুব ভুল কাজ। মানুষটি মাদকাসক্ত হতে পারে, অপরাধ প্রবণতা থাকতে পারে, তার সাথে আপনার বা আপনার পরিবারের আদর্শগত পার্থক্য-ও থাকতে পারে নানা রকম। এসব উপেক্ষা করে সম্পর্কে জড়ালে কেবল কষ্টই বারে, এবং একসময় পরিণাম হয় ভাঙ্গন।
- প্রেম থাকবে, পছন্দের মানুষ থাকবে। তবে তার কারণে লেখাপড়া বা অন্য কাজের ক্ষতি করলে চলবে না মোটেই। তারুণ্যটাই সময় ভবিষ্যৎ গড়ার। আর এই সময়ে যদি নিজের লেখাপড়া/ কাজে মনযোগী না হন,তবে ভবিষ্যতে না থাকবে সফলতা আর না থাকবে ভালবাসা।
- নিজে যেমন মনযোগী হবেন, তেমনি আপনার পছন্দের মানুষটিকেও সচেতন করে তুলবার চেষ্টা করুন তার কেরিয়ারের প্রতি। আজকাল প্রেম মানে মোবাইল ফোন, ফেসবুক, চ্যাট, ডেটিং... সবই থাকবে, বাদ দিতে বলছে না কেউ। তবে অবশ্যই পরিমিত ভাবে। কথা বলবেন, চ্যাট করবেন? করুন না, তবে নিজ নিজ লেখাপড়া/ কাজ শেষ করে তবেই। নিজের কর্তব্যে ফাঁকি দিয়ে সম্পর্ক গড়তে চাইলে সইয়ে সম্পর্কও একসময় ফাঁকি দিয়ে চলে যায়।
- সম্পর্কে ঝগড়া হবেই। ঝগড়া হবে, আবার মিলে যাবে। কখনো কখনো হয়তো ভেঙ্গেও যাবে সম্পর্ক। কিন্তু তাই বলে কি জীবন শেষ হয়ে যায়? সম্পর্কের ভাঙ্গন জীবনের রীতি, আর যে সম্পর্ক থাকবার নয় তার ভাঙ্গন ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না কেউ শত চেষ্টাতেও। একটা জিনিশ ভেবে দেখুন তো, সেই মানুষটি যদি আপনাকে ছেড়ে ভালো থাকতে পারে তবে আপনি কেন পারবেন না? কষ্ট হবে, খারাপও লাগবে, মন ভাঙ্গার ভীষণ যন্ত্রণা হবে। তবে তাতে তো বেঁচে থাকা বিসর্জন দিলে হবে না। বরং জীবনে সফল হয়ে মানুষটিকে দেখিয়ে দেয়া যেতে পারে যে আপনাকে কষ্ট দিয়ে সে কি ভীষণ ভুল করেছে!
- ভালবাসার মানুষটির জন্য কখনো নিজের পরিবারের সাথে খারাপ ব্যবহার করবেন না। প্রেমিক/ প্রেমিকা ছেড়ে যেতে পারে অনায়াসেই, পরিবার কিন্তু কখনো সঙ্গ ছাড়ে না। যে পরিবার এতগুলো বছর আপনাকে আগলে রেখেছে, অল্প কিছুদিনের সম্পর্কের জন্য তাদের সাথে প্রতারণা করা একেবারেই অনুচিত। হতে পারে আপনার পরিবার বিরুদ্ধাচরণ করছে আপনার প্রেমের, হতে পারে আপনাকে বাঁধা দিচ্ছে। দিতেই পারে, আর সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই কারণে কখনো মা বাবা ভাই বোনের সাথে যুদ্ধে নামবেন না। সময় দিন। আপনাদের সম্পর্ক সত্য আর সুন্দর হয়ে থাকলে একদিন তা পরিবারের মন জয় করবেই করবে।
- সম্পর্কে এগোনোর আগে নিজেকে সময় দিন। এটাই সেই মানুষ তো? ঠিক আপনার মনের মতন একজন মানুষ তো? কম বয়সে আবেগের আতিশয্যে মানুষ নির্বাচনে ভুল হয়েই যায়। ভুল সম্পর্কে জড়িয়ে মন ভাঙ্গার চাইতে জড়াবার আগেই একটু ভালো করে ভেবে দেখা ভালো। আর তাই, কেউ এসে ভালবাসি বললেই হ্যাঁ বলে দিবেন না।
- পৃথিবী যতই আধুনিক হোক না কেন, এখনও কিন্তু সমস্ত সম্পর্কেরই আছে কিছু সীমারেখা। আমরা বাংলাদেশী, আমাদের আছে কিছু সামাজিক বিধি- নিষেধ আর খুব চমৎকার কিছু সংস্কৃতি। এই ব্যাপারগুলো সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে অবশ্যই। বিবাহ পূর্ব শারীরিক সম্পর্ক যে কেবল সমাজের চোখে নিষিদ্ধ তাই নয়, আপনার জন্য তা বিপদজনকও বটে। আবেগ থাকবেই, কিন্তু নিজেদের সামলে চলুন। আপনার সঙ্গী বা সঙ্গিনী যদি আপনাকে ঘনিষ্ঠ হবার জন্য চাপ সৃষ্টি করে তাহলে নিশ্চিত রূপেই বুঝে নিবেন যে সে আপনার শরীরটাকেই কেবল ভালবাসে, আপনাকে নয়।
- তারুণ্যতে প্রেম মানেই যে তা ভেঙ্গে যাবে বা স্থায়ী হবে না, এতই খুবই ভুল একটি ধারনা। তারুণ্যের সম্পর্ক অহরহই বিয়েতে গড়ায়। তাই সেই ব্যাপারটা অবশ্যই মাথায় রাখবেন। নিজের পছন্দের মানুষটির কাছে কখনোই নিজের পরিবার, আত্মীয়, বন্ধুদের নামে কুৎসা করবেন না। পরে কিন্তু সেটা বিপদ ডেকে আনবে আপনার জন্যই।
- একই সাথে একাধিক মানুষের সাথে প্রেম কেবল তারুণ্যে নয়, যে কোনও বয়সেই অনুচিত। অবশ্যই সেটা থেকে বিরত থাকুন।
জীবন থাকলে প্রেম থাকবেই। নানান বয়সে নানা চেহারায় প্রেম এসে উপস্থিত হবে জীবনে। প্রেমহীন জীবন যেমন কল্পনা করা যায়না, তেমনি প্রেমটাই জীবনের শেষ কথা নয়। সম্পর্ক গড়া যেমন সুখের, ভাঙ্গাটা ঠিক ততটাই কষ্টের। তাই চেষ্টা করুন নিজের সম্পর্ক গুলোকে যত্নে রাখতে, মমতার বাঁধনে জড়িয়ে রাখতে। কেবল প্রেম নয়, সকল সম্পর্ককেই। দেখবেন জীবনের অর্থটাই যেমন বদলে যাবে, ঠিক তেমনি প্রেমের সম্পর্কটাও হবে ভীষণ ভীষণ সুন্দর।
0 comments:
Post a Comment