শুক্রবার, এগার ডিসেম্বর, পনের ।
কেন তা জানিনা, তবে অন্যান্য দিনের চেয়ে খুব সকালেই ঘুম ভাঙল । সকাল নটার দিকে সিদ্ধান্ত হলো তোমাকে নিয়ে নিউমার্কেট যেতে হবে, তোমার নাকি অনেক কেনাকাটা আছে । এগারটা দিকে আমরা তোমাকে নিয়ে নিউমার্কেটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম । সিদ্ধান্ত নিলাম ধামরাই-গুলিস্তান এর গাড়ীতে যাবো, কারণ ঐ গাড়ীটা নিউমার্কেটের সামনে দিয়ে যায়, খুব সহজে তারাতারি যাওয়া যায় । কিন্তু তুমি বায়না ধরলে, না দোতালা বাস তোমার পছন্দ, তুমি দোতালা গাড়ীতেই যাবে এবং দোতালায় জানালার পাশে বসে যেতে তোমার ভাললাগে । তাই বাধ্য হয়ে দোতালা গাড়ীতেই তোমাকে নিয়ে জানালার পাশে বসলাম, গাড়ী চলতে লাগলো ।
আমি তোমাকে নিয়ে জানালার পাশে বসলাম । সামনের এক সীট পরে এক বয়স্ক ভদ্র লোক আর আমাদের পিছনের সীটে দুটো যুবতী মেয়ে বসেছিল । তোমার মনে পরেছে কি? আমার কোলে বসার সাথে সাথে আমি তোমাকে বলেছিলাম, সামনের সীটটা শক্ত করে ধরো এবং খেয়াল রেখো, গাড়ী ব্রেক করলে তোমার মুখে আঘাত লাগতে পারে । যদিও আমি তোমাকে খুব সামধানে ধরে রেখেছিলাম, তারপরও কথার ফাঁকে তোমার দাতে আঘাত লেগেছিল, কি তাও মনে করতে পারছোনা !
গাড়ী চলার সময় রাস্তার পাশে যাকিছু দেখেছো, শুধু প্রশ্নই করেছো, আমি অকপটে হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেছি । হয়ত সে প্রশ্ন কমপক্ষে কয়েক হাজার । মাঝে মাঝে তোমার মা চুপ থাকতে বললেও আমি আবার বলতে বলেছি । কোন কথা হয়তো বহুবার জিগ্গাসা করেছো, বলেছি । সামনের ভদ্রলোক তোমার জানার কৌতুহল দেখে বলল “লট অফ কিউওরিসিটি” । তারপর একসময় নিউমার্কেটে পৌছে গেলাম ।
তুমি ভাবতে পারো এগুলো লিখে রাখার মানে কি? সত্যিই লিখে রাখার কোন মানে নেই । শুধু তোমাকে মনে করিয়ে রাখা ছাড়া । কারণ এখন তুমি একটা প্রশ্ন দশবার জিগ্গাসা করো, আমি রাগ করিনা, হাসিমুখে দশবারই জবাব দেই । সেদিন আমাকে অন্তত তিনবার জিগ্গাসা করার সুযোগটুকু দিও, রেগে যেওনা । আজ তুমি না বুঝে কৌতুহলবশত জিগ্গাসা করছো, আর সেদিন আমি কানে শুনতে পাবোনা বলে বাধ্য হয়ে জিগ্গাসা করবো । তাই শুধু মনে করিয়ে রাখতে চাই যে তোমার জীবনেও এমনদিন ছিল, যেদিন তুমি একই প্রশ্ন দশবার জিগ্গাসা করতে ।
তুমি হয়ত লক্ষ করবে, প্রতিবার ড্রেস কেনার সময় তোমার পছন্দের গুরুত্ব দিয়ে আমার সাধ্যের বাইরে গিয়েও কিনে দেওয়ার চেষ্টা করি । কেন জানো? কারণ তুমি একবারে হুট করে বড় হয়ে যাচ্ছোনা, যে অতীত ভুলে যাবে । যেহেতু ধীরে ধীরে বড় হচ্ছো, তাই আজকের দিনের কথা তোমার কিছুটা হলেও মনে থাকবে । আর যেদিন আমি তোমার উপর নির্ভরশীল হয়ে পরবো, সেদিন যেন অন্তত আমার মৌলিক চাহিদাটুকু আগ্রহ সহকারে পুরন করো ।
তুমি হয়ত লক্ষ করবে, প্রতিবার রেস্টুরেন্টে তুমি যখন তোমার পছন্দের্ পিতজা, চিকেন ফ্রাই, বার্গার এই তিনটা খাবার তৃপ্তি সহকারে খাও, আমি তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবী, এই দিনটি আমার জীবনে কবে আসবে ! আদৌ আসবে কিনা ! কারণ আমার আজকের অবস্থানে তোমার দাদা ছিলোনা, আমি গ্রামে বড় হয়েছি । ভাবী আর চোখের কোন ভীজে যায়, যে যেদিন আমার পকেটে পয়সা থাকবেনা, কিংবা আয়ের সামর্থও থাকবেনা, সেদিন কি তুমি খাবারের অর্ডার দিয়ে এভাবে পরম মমতায় আমার খাবার অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকবে? নাকি দুবেলা ভাতের জন্যই চরম অনিশ্চয়তায় কাটবে আমার প্রতিটা মুহুত !
আজ আমার সাধ্য নেই তাই তোমাকে নিয়ে রিক্সায় ঘুরে বেড়াই । সেদিন হয়ত তোমার গাড়ী থাকবে । তবুও্ সময় পেলে মাঝে মাঝে আমাকে একটু রিক্সায় নিয়ে হসপিটালে, সেলুনে, মসজিদে নিয়ে যেও । আর আজকের এই ছোট্ট হাতটা যেদিন খুব শক্ত হবে, সেদিন আমার কোলের উপর দিয়ে রিক্সার অপর প্রান্তের হুকটা ধরে রেখো, আমি যেনো পরে না যাই । কারণ নিরাপত্তা দেওয়ার চেয়ে নিরাপত্তা নেওয়া অনেক বেশী আনন্দের ।
আমি জানি সেটা তুমি কখনোই পারবেনা । সময় তোমাকে পারতে দেবেনা । আমাকেও দেয়নি । তুমি টাকা দিয়ে হয়ত দিনের ভাল থাকার নিশ্চয়তা দিতে পারবে, কিন্তু রাতের ঘুম এনে দিতে পারবেনা, পুরণ করতে পারবেনা তোমার শুন্যতা । যেমনটা আমি পারছিনা । আমি বুঝি আমার বাবাও পচিশ বছর আগে এই কথাগুলো ভাবতেন, হয়ত তখন ফেইসবুক বা কম্পিউটার ছিলনা, তাই লিখে রাখতে পারেননি । কিন্তু এমন জায়গায় লিখে রেখেছেন, যেটা কোনদিন মোছার নয় । মুছতে না পারার কষ্ট আর কাউকে না দেখাতে পারার কষ্ট, প্রতিনিয়ত দম বন্ধ করে দেয় । বিশ্বাস করো পাপা...সত্যিই খুব ভয় করছে, আজ আমার বাবা যে কষ্ট সহ্য করছে, আমি কি তা সইতে পারবো? না পেরেও বা উপায় কি? হয়ত সময়ই সহ্য করার মতো শক্তি আর ক্ষমতা তৈরি করে দেবে ! হ্যা তাই দিও...আজকের অবস্থা সেদিন থাকলে...সহ্য করতে পারবোনা ।
0 comments:
Post a Comment