আত্মীয়-স্বজনদের সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো যতোটা সম্ভব এড়িয়ে চলেন মিসির আলি । এর পেছন অন্যতম কারণটি অর্থনৈতিক। এসব অনুষ্ঠানে যাওয়া মানেই গুচ্ছের টাকা খরচ । উপহার কেনা, ট্যাক্সি ভাড়া করে যাওয়া-আসা । কোনো মানেই হয় না। তার চেয়ে বাড়িতে পোলাউ মাংস রেধে খাওয়া অনেক ভালো ।
বুদ্ধিটা খারাপ না, তাহলে এককাজ করলে কেমন হয়, সকল আত্নীয় স্বজনকে এই মর্মে একটা নোটিশ করে দেই, প্রথমত; আমি তোমাদের সাথে আর কোন যোগাযোগ রাখতে চাইনা, তোমরা তোমাদের রিলেশনশীপের খাতা থেকে আমার নাম কেটে দাও । আমি কোন সামাজিকতা রক্ষা করতে পারছিনা, কারণ আমি প্রাইভেট কোম্পানীতে জব করে বড্ড অসামাজিক হয়ে যাচ্ছি দিন দিন । তাই আমার এই অসামাজিকত্ব কাযকলাপ নিয়ে আমি একা থাকতে চাই, তোমাদের বিরক্ত বা বিব্রত করতে চাইনা । দ্বিতীয়ত; আমি আমার পুরানো ঠিকানা বদলে ফেলেছি, এটাতো বলতে পারছিনা যে নতুন ঠিকানা তোমাদের দেবোনা, তবে পরে পাঠিয়ে দেবো । তৃতীয়ত; আমার সাপ্তাহিক ছুটির দিন এখন শুক্রবারের পরিবর্তে সোমবার । আবার শুক্রবার হলে আমি আপনাদের জানাব । তাই বতমানে আমি কিছুদিন আপনাদের সাথে কোন সামাজিক/পারিবারিক সম্পক রক্ষা করতে পারছিনা, আর এরজন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত ।
যারা গত পাঁচ বছরে তাদের আত্নীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন না, কারণ প্রাইভেট কোম্পানীতে জব করেন, তারা প্রত্যেকে এধরনের একটি চিঠি লিখে আত্নীয়দের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে পারেন, তাহলে অন্তত তারা মাঝে মাঝে আপনার পাঠানো চিঠিটি দেখে শান্তনা পাবে ।
সম্পর্ক আসলে কেমন/কি বিষয়, সেটা বুঝতে পারছিনা, তবে অনেকদিন যোগাযোগ না থাকলে একটা অচেনাভাব, একটা লজ্জা, কিংবা সবশেষে মন থেকে মুছে যায় । কারণ আমাদের মনেরও একটা স্পেস লিমিট আছে । যখন তার ভিতরের স্পেস কমে আসে তখন সে পুরানো দিনের মানুষগুলো এবং তাদের স্বৃতিগুলো, যেগুলো অনেকদিন মনে করা হয়নি বা তাদের সাথে যোগাযোগ করা হয়নি, সেগুলো পিছন থেকে মুছে দেয় । আর ওতো আপনার অফিসের সুন্দরী কলিগ নয়, যে কোন ফাইল হারিয়ে ফেললে মিথ্যা বাহানায় জারী মারবেন কিংবা এটা কড়া ভাব নেবেন যাতে সে যেনো আপনাকে বসে আনার জন্য আপনার পিছনে ঘুর ঘুর করে । মনকে আর কি বলতে পারবেন, বড় জোর মাথার চুলগুলো টেনে টেনে বলবেন, দুর ছাই ইদানিং কি যে হইছে কিছু মনে রাখতে পারছিনা, এর চেয়েতো বেশী কিছু নয় ।
মন বা মাথা কোনোটার দোষ দিয়ে লাভ নেই । মাঝে মাঝে অতীতের সেই মানুষগুলো রঙিন স্মৃতিগুলো একটু মনে করুন । একদিন যারা আপনার জীবনে অনেকটা ছিলো । যখন আজকের আপনি ছিলেন না । হতে পারে, সে গ্রাম্য কাকা, কিংবা দুসম্পর্কের কেউ, কিংবা মোড়ের ফুসকাওয়ালা, কিংবা স্কুলের সামনের সেই আচারওয়ালা, কিংবা আপনার সেই খালামনিটা যে আপনার শৈশবটাকে মাতিয়ে রাখতো, কিংবা সেই ভ্যানওয়ালা যে রোজ পরম মমতায় আপনাকে স্কুলে নিয়ে যেতো, কিংবা সেই রহিমা খালা ঝড় বৃষ্টি তুফানেও যে রোজ আপনার টিফিন রেডি করে দিতো, কিংবা সেই দুধওয়ালা যে না আসলে সেদিন আপনার খাওয়া হতোনা, কিংবা সেই মাস্টার মশাই যে রোজ আপনাকে পেটাতো কিংবা মেয়েদের সামনে কান ধরে দাড়া করিয়ে রাখতো, কিংবা ক্লাসের সেই ছোট্ট মেয়েটি যে আপনার বই ছিরে দৌড় মারতো, কিংবা যে মেয়েটি আপনার চিঠি নিয়ে স্যারকে দিয়েছিল খুব মেরেছিল সেদিন, কিংবা পাশের বাড়ীর শেফালী যার ভালবাসা আপনি কোনদিন বুঝতেই পারেননি, কিংবা সেই বৌদি মনির কাগজওয়ালা যে রোজ আপনাকে মিথ্যা মিথ্যা গল্প শোনাতো, আরো....আরো অনেকে.......চেষ্টা করুন না, ওদের নাম্বার যোগার করতে পারেন কিনা? একদিন একটা ফোন দিন, দেখবে ওদের ঘরে আনন্দের বন্যা বয়ে যাবে, আপনার ফোন পেয়ে । হয়ত সেটা আপনার কাছে কিছুই কিন্তু ওদের কাছে অনেক কিছু । শুধু একবার ফোন দিয়ে বলুন
.......হ্যালো আমি বলছি...তোমার.......!
দেখবে আর কিছু বলতে হবেনা । তারপর আপনি শুধু চুপ করে থাকবেন । আর অনুভব করবেন..জীবনে ফোনে এতকথা বলেছেন, কখনো কি এরকম ভাললাগা অনুভব করেছেন কিনা ?
আপনার জীবনে এমন কিছু মানুষ আছে বা তাদের স্মৃতি জড়িয়ে আছে, যাদের আপনি খবরও রাখেন না, হয়ত আপনার কাছে তাদের অস্তিত্ত্ব মুল্যহীন কিংবা সস্তা । কিন্তু তাদের কাছে আপনার কতটা মুল্য তা আপনার কল্পনার বাইরে । আপনার কাছে তারা হয়ত মাসে মাসে মোটা মোটা টাকা পাওয়ার অধিকার রাখেনা বা চায়না । কিন্তু বাইরেও তারা কিছু প্রত্যাশা করে, আর সেটা করা অন্যায় নয় । যা পূরন হওয়ার মাধ্যমে তাদের জীবনে বয়ে যেতে পারে, সুখের বন্যা ।
প্রতিদিন আমরা হাজারো কল করি, প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে । কেউ কেউ হয়ত ফোন পেয়ে বিরক্ত হয়, কেউ ব্যস্ততার ভান করে, কেউবা এরিয়ে চলে, আবার হয়ত আমি অনেককে খুব গুরুত্বের সাথে ফোন করি, হয়ত সেটা কারো কারো কাছে গুরুত্বহীন । এটা আমাদের দৈনন্দিন রুটিন। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ আমাদের দৈনন্দিন রুটিনে নেই, যাদের সম্পর্কের নামে ধুলো পরে গেছে, আমাদের একটা ফোন কল তাদের কাছে যে কতটা গুরুত্ববহন করে, তা লিখে বলা যাবেনা । শুধু বলতে পারি, স্বার্থের বাইরেও আনেক ভালবাসা থাকে, প্রাপ্তি থাকে । তাই সেইসব আত্নীয়দের সাথে অন্তত ফোনে একবার যোগাযোগ করুন, যারা এসসময় আপনার জীবনে ছিল । প্রতিদিন না পারেন সপ্তাহে অন্তত ছুটির দিনটায় একটা ফোন করুন, দেখবেন দুজনেরই ভাল লাগবে ।
পৃথিবীতে যত শব্দ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে দামী শব্দ সম্পর্ক । তাই কোন সম্পর্কেই মরে যেতে দেবেন না । জল ডালার মতো মাঝে মাঝে খোজ খবর রাখুন । তাকে বোঝতে বাধ্য করুন, কেউ না থাকলেও আমি তো আছি, যেনো আপনাকে অবলম্বন করেই সে বেচে থাকতে পারে । অন্তত এই সাহসটুকু তার মধ্যে জাগিয়ে তুলুন । কারণ আপনার একটু অনুপ্রেরণাই তাকে এই সাহসের সাথে বাচিয়ে রাখতে পারে । নিজে বাঁচা কোন গর্বের বিষয় নয়, অন্যকে বাচিঁয়ে রাখা সত্যিই গর্বের । হয়ত অনেক কাজের জন্য পুরুষ্কার পাওয়া যায়না, কিন্তু রাতে শান্তিতে ঘুম হয় ।
0 comments:
Post a Comment