এই দেখ দেখ, ওটা কী যাচ্ছে ভাই? কী ওটা’? রাস্তাঘাটে বা পাড়ার মোড়ে এই
ধরনের টিটকিরি তো হামেশাই শোনা যায়। আর এই টিটকিরি ঠিক কাদের লক্ষ্য করে
বলুন তো? নিশ্চয়ই বুঝতে পেরে গেছেন যে সমকামী, উভকামী বা রূপান্তরকামীদের
কথা বলা হচ্ছে। এই তাচ্ছিল্য, উপহাস গায়ে না মেখেই ওরা থাকে ওধারে। বয়ে
নিয়ে যায় জীবনযাপনের পরম্পরা। নিজেদের মধ্যে ভাগ করে সুখ এবং দুঃখ। উৎসবের
আয়োজনও করে। সম্প্রতি ব্যারাকপুরের একটি সংগঠনের উৎসবে উঠে এল অন্য যৌনতার
সেই অপরিচিত মুখ।
যদিও এই বিষয়গুলো সমাজের বুকে নতুন কিছু বা ব্যতিক্রমী নয় একেবারেই।
পৌরাণিক প্রসঙ্গে অর্ধনারীশ্বর বা শিখণ্ডী এবং অজন্তার গুহাচিত্রে এই
সমান্তরাল যৌনচেতনার নিদর্শন মেলে। সাহিত্যের দলিলেও রয়েছে এর অস্তিত্ব; তা
সে শেক্সপিয়রের সনেটেই হোক বা হোক সিমোন দ্য বোভোয়া-র ‘দ্য সেকেন্ড
সেক্স’। কানে আসে, এই ব্যতিক্রমী পথের পথিক ছিলেন মাইকেল জ্যাকসন বা
মার্টিনা নাভ্রাতিলোভার মতো নক্ষত্র। কিন্তু রূপান্তরকামী সৌরভ দাসের কথায়
উঠে এল দল-মত নির্বিশেষে সভ্যতার মুখোশ পড়া তথাকথিত ভদ্র সমাজের তাদের
প্রতি বৈষম্যমূলক আচরনের কিছু চিত্র।
এমনকি সমকামী বা রূপান্তরকামীদের প্রতি ছুঁড়ে দেওয়া তৎসম, তদ্ভভ
বিশেষণগুলির সাফল্য কামনা করে ‘আম আদমি’ এদের আসল পদবীও পরিবর্তিত করে দেয়
এবং সেই জায়গা অলঙ্কৃত করে ‘বউদি’ বা ‘লেডিজ’-এর মতো শব্দগুচ্ছ। কখনও কখনও
এদের অঙ্গভঙ্গী নকল করেও বীরত্ব প্রকাশ করেন দোকানদার থেকে পথচলতি লোকজনও।
মানবিকতার প্রতীক হাসপাতালে এদের ভর্তির সময়েও সূত্রপাত হয় চরম বিতর্কের!
সেখানে বিতর্কের বিষয় অবশ্য পুরুষ না মহিলা- কোন ওয়ার্ডে ভর্তি নেওয়া হবে
সেই নিয়ে। অবশ্য সেই বিতর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয় না, দু’পায়ের ফাঁকে লিঙ্গই তখন
বাতলে দেয় আসল পরিচয়। রাস্তাঘাটে বিপদের সম্মুখীন হলে প্রশাসনিক সাহায্যও
শুধুমাত্র তখনই পাওয়া যায়, যদি কোনও ক্ষমতাশালী ব্যক্তি বাড়িয়ে দেন
সাহায্যের হাত কিংবা কোনও সমকামী বা রূপান্তরকামী যদি বুনতে জানেন কথার
জাল। প্রায় একইরকমের বৈষম্যের স্বীকার বৃহন্নলারাও যাদের চলতি ভাষায় আমরা
হিজড়া বলে চিনি। এই গোত্রেরই এক ব্যক্তি কাশ্মীরা গুহ ঠাকুরতা জানালেন তাঁর
অভিজ্ঞতার কথা। হয়তো এমনও হয় রাস্তাঘাটে যাঁরা স্বাভাবিকভাবেই গল্পগুজব
করছিলেন তাঁর সঙ্গে, তিনি চলে যেতেই তাঁরা বিরক্তিমাখা গলায় বলে উঠলেন, ‘সো
ইরিটেটিং’।
এ তো গেল প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের সামাজিক অবস্থান ও প্রেক্ষাপটগত
জটিল আলোচনা। কিন্তু তাঁরা কী ভাবনাচিন্তা করেন, তাঁদের আলোচনার বিষয়ই বা
কী- এই কৌতূহলের পরিতৃপ্তির জন্য ‘অ্যামিটি ট্রাস্ট’-এর একটি কার্যালয়ে
উপস্থিত হওয়া গেল। অতি কষ্টে জোগাড় করা গেল সমকামী এবং রূপান্তরকামীদের
আড্ডাঘরে প্রবেশের পরোয়ানা। ‘ভাগ মিলখা ভাগ’ সিনেমার গান থেকে মুক্তির
অপেক্ষায় থাকা ‘মিশর রহস্য’ সিনেমা দেখতে যাওয়ার আগাম পরিকল্পনা, পরিচিত
কারও সমবিবাহ সংক্রান্ত আলোচনা থেকে থেকে দীঘা বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান বা
ফেসবুকে কমেন্ট সবই তাদের আড্ডার বিষয়।
অবশ্য এই প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের দাবিদাওয়া নিয়ে যথেষ্ট সচেতনতার
পরিচয় দিয়েছে তিলোত্তমার যুবসমাজ। তাই শুধুমাত্র ‘প্রাইড ওয়াক’ বা রেনবো
মিছিলেই আটকে না থেকে লিটল ম্যাগাজিন, গান, নাচ এমনকি নাটককেও বার্তা বহনের
মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে জেন-ওয়াই। সম্প্রতি যেমন ব্যারাকপুরে ‘রিদম
সেন্টার ফর পারফর্মিং আর্টস’ কোনও বিতর্কে না গিয়ে সমসাময়িক জ্বলন্ত বিষয়
হিসেবে সমকামিতাকে তুলে ধরেছিলেন ‘অনন্ত শূন্যতা’ নাটকের মাধ্যমে। মহানগরীর
বুকে ‘অর্ধেক আকাশ’, ‘স্যাফো ফর ইকুয়্যালিটি’, ‘অবমানব’ মঞ্চগুলি
লিঙ্গবৈষম্যের বিরোধিতা করে। এখানেই শেষ হয় না সংগ্রাম। সেই সঙ্গে যে
সম্পর্কে সন্তান উৎপাদন হয় না, সেটি আসলে কোনও সম্পর্কই নয়- এই তত্ত্বেরও
বিরোধিতা করে। তাঁদের আরও দাবি- প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের শোধরানোর নামে
তাদের উপর করা কারেক্টিভ রেপ অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিত।
সমকামিতা বিষয়টিকে বিজ্ঞান দেখে শুধুমাত্র একটি জৈবিক ক্রিয়া হিসেবে,
কিন্তু আসলে এটি একটি জৈব-মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া যেটি গঠনের পিছনে
আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটও সমানভাবে দায়ী। খুব সম্প্রতি আর্জেন্টিনার আইনসভা
‘লিঙ্গের সমাপ্তি’ ঘোষণা করে প্রকারান্তরে মেনে নিয়েছে লিঙ্গ-সাম্যতা।
আমাদের দেশের এলজিবিটি সম্প্রদায় সমাজের থেকে সহানুভূতি চান না, তাঁরা চান
না লোকদেখানো শ্রদ্ধাও। তাঁরা শুধু দেশের সাধারণ নাগরিকের মর্যাদাটুকুই
চান, আর চান সমাজের মূল স্রোতে গা ভাসাতে। কলকাতা সেই পরিসর তৈরি করছে
আস্তে-সুস্থে। শুরু হয়েছে দিন বদলের পালা। তারই যেন প্রতীক হয়ে থাকল
সাম্প্রতিক এই উৎসব।
0 comments:
Post a Comment