প্রিয়তিনী


এই আনমনা অংশুমালীর, এই নির্ভৃত বেদনজর্জরিত অবজ্ঞাচিত্তচারীর দেওয়া সুনিবিড় মায়াসঞ্চিত অমৃতধারাটুকু অকুন্ঠ চিত্তে গ্রহণ করিয়া তোমার সপ্রভ হৃদয়নিকুঞ্জনিকেতনে স্থান দিয়া ধন্য করিবে বলিয়া আশা করিতেছি।

অনাদিকালের রূপ-লাবণ্য সমাহিত এই সুন্দরী কল্লোলিনী ধরনীপারে আমার এমন কোন সুদীপ্ত-চন্দ্রিত উপহার ডালি নেই যাহা উৎসর্গিত করিয়া তোমাকে সুখের চূঁড়াতে ফুল দিতে বলিব। তবুও আমার মনের চির ঝংকৃত অলঙ্কার হইতে যে সুঝলমল সুতীব্র ভালবাসা তোমার জন্য অবিরাম দোলায়িত হয় মাধুকরী ছন্দে, সেই ভালবাসা, নিতান্ত তোমার জন্যই যে গভীর কোমল টান, সেই টান, সেই ভালবাসা তোমার নিষ্পাপ মনমন্দিরপিঞ্জরে সমাধিত করিয়া আমাকে ঋণী করিও।

হয়তো তোমার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র লিপিখানি যথেষ্ট নয়, তবু পীনোন্নত প্রতিচ্ছায়া হইয়া তোমাকে অনুরোধ করিতেছি, তুমি আমার উপর রাগ করিও না। বিলম্ব করিয়া হইলেও যে প্রত্যাশা মনের ভিতর প্রতিভাত করিয়া দুটি কথা তোমাকে লিখিতেছি তার কতটুকু মূল্য তোমার নিকট থেকে পাইব জানিনা, তবে এই চিঠিখানি পাইবার পর যদি অতি সামান্যতম রাগ, বিরাগ, ব্যথা, বিরহ, টান, কষ্ট, ভালবাসা ইত্যাদির যেকোন একটি তোমার মনে অনুভূত হইয়া থাকে তবে আমার এই লেখা স্বার্থক হইবে, নচেৎ আমি নিজেই প্রত্যাখ্যাত হইবো তোমার সুপ্তোন্মুখ প্রণাম হইতে।

প্রিয়তিনী, আজি লিখিতে বসিয়া এত প্রবল একটা ধাক্কা আমার মনের চারিদিকে প্রদক্ষিণ করিতেছে যা কয়েকদিন সঞ্চিত নিঃশব্দ শ্রান্তি আর অবসাদে জর্জরিত, যাহার প্রভাবে একটি কথাই শুধু আমার মনে বার বার উঁকি মারিতেছে যে, মানুষের কাছে সঠিকভাবে প্রকাশ করিবার উপায় বোধ হয় আমার জানা নেই। যে প্রভা, যে জ্যোতি, যে প্রবৃত্তি কঠিন, নির্মম অথচ খাঁটি সত্যের ভিতর দিয়া প্রবাহিত হইয়া থাকে, যা মানুষকে আনিয়া দেয় বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়াইবার দৃঢ়তা, সাহস, সেই প্রবৃত্তি, সেই প্রভা, সেই জ্যোতি তথা সেই সত্য নিয়ে আমি সবার সামনে নিজেকে প্রকাশ বা উন্মুক্ত করিবার চেষ্টা করিয়া থাকি, কিন্ত কি পাই, কি পাইয়াছি সেদিকে আজ যাইবো না, শুধু এইটুকু বলিতে দ্বিধা নেই, “যেন মানুষের কাছে আমি প্রভাতফেরী গাইয়া চলিতেছি, যাহার শ্রোতা আমি নিজেই, যেন অনেকগুলো সুদর্শনী ফুল লইয়া প্রদর্শন করিয়া বেড়াইতেছি, যাহার দর্শক আমি নিজেই, অর্থাৎ যে গায়ক সেই-ই শ্রোতা, যে প্রদর্শনকারী সেই-ই পরিদর্শক। যেন আমি ব্যস্ত ঢেউয়ের মতো অগোছালো, শুধু নদীর সংগে রাতিদিন দাপাদাপি।

প্রিয়তিনী, তোমার মানসপুরী কোন শ্বেতপ্রস্তরখচিত অভ্রভেদী সৌধশ্রেণীদ্বারা রচিত আমি জানিনা, তেমার হৃদয়ের আসন কোন স্বর্ণঝালরখচিত বিচিত্রবর্ণের অরুণালোকদ্বারা রঞ্জিত জানিনা, কোন হীরকজ্যোতিশিখার দ্বারা তোমার মনমালিকা অলংকৃত আমি বুঝিনা, শুধু এই জানি, এই বুঝি, আমার অন্তরের নিস্তরঙ্গ, নিঃসঙ্গ অতল গহ্বর থেকে বাহিত সিক্ত অঞ্জলিপ্রবাহ কোনদিন তোমার মনের মতো ঐশ্বর্যিত হইল না। আমার অতিবিস্তৃত, অতিসুদুরপ্রাকৃত মমতামিশ্রিত চিত্তবেদনা কখনো তোমার সুহৃদয়ের মধুকুঞ্জে সুললিতভাবে সুর মিলাইতে পারিল না। আমার চিরকালের দুঃখটা শুধু এখানেই। এত আশা, এত আকুলতা, এত ব্যাকুলতা তোমার জন্য আমার ভিতর হইতে বিচ্ছুরিত হয়, তবুও বারে-বারে ফিরিয়া ফিরিয়া তোমার অবহেলা আর অবজ্ঞায় ছিন্ন-ভিন্ন হইতেছি ক্ষণে ক্ষণে।

0 comments:

Post a Comment

" কিছু স্বপ্ন আকাশের দূর নীলিমাক ছুয়ে যায়, কিছু স্বপ্ন অজানা দূরদিগন্তে হারায়, কিছু স্বপ্ন সাগরের উত্তাল ঢেউ-এ ভেসে যায়, আর কিছু স্বপ্ন বুকের ঘহিনে কেদে বেড়ায়, তবুও কি স্বপ্ন দেখা থেমে যায় ? " সবার স্বপ্নগুলো সত্যি হোক এই শুভো প্রার্থনা!