তখন ঝিলমিল রাত


তারপর একসময় বৃষ্টি ধরে এল। একসময় মানে, শহরে সন্ধে নামার রাতকলি মুহূর্তে। বৃষ্টির বোলচাল বদলে এখন ঘনঘন রিমঝিম থেকে টিপিস-টিপিস। সে তেহাই দিচ্ছে কখনও টুপ-টাপ-টুপ! কালো মেঘের চাদর কেটে কেটে কখন ফিকে হয়ে গেল গহন ভাদরের গগনও। নিঃশ্বাসে বুঝতে পারছি, বাতাসে বৃষ্টির গন্ধে একটু একটু করে জায়গা করে নিচ্ছে কলকাতার নিজস্ব গন্ধ।


নির্জন পথের একটা বাঁক ঘুরতেই নিওনের আলোয় রঞ্জাকে দেখতে ইচ্ছে করল ফিরে ফিরে। ওর বুকের গন্ধ নাকে এল, নাগরিক গন্ধ সরিয়ে। বৃষ্টি ভিজে চোখের কাজল, এখন স্মোকি হয়ে গেছে। বেশ গহন। যেন স্মাজার দিয়ে উজানে আলতো টান দিয়েছে ও! চিবুকের তিলটা মারকাটারি লাগছে।


দেখতে দেখতেই দিলভাসান। মনে হল, ওই অদূরে লেকের কথা। লেকের জলে সদ্য সদ্য বৃষ্টির জল যে বর্ষামঙ্গল কাব্য লেখা শেষ করেছে, গাছেরা তুমুল উৎসাহে হয়তো পড়ে ফেলবে আজ, এক্ষুনি-এক্ষুনি। একটা প্রাচীন ইউক্যালিপটাস গাছের নিচ দিয়ে যেতে যেতে মনে হল, লেকের কালো জলে ওদের ছায়ার সাপ দীর্ঘ হচ্ছে!


এই শহরের মধ্যে রোজ এমন কত যে কাব্য লেখা হয়- বিজন সেতু, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ, সরোবর, পূর্ণদাস রোড, আহিরিটোলারা জানে তার খবর। এলোমেলো এসবের কথা ভাবতে ভাবতেই কখন দু’জনে এসে পড়েছি যোধপুর। ২৮/৪ গড়িয়াহাট রোডের তন্দুর পার্ক। প্রথম পেগটা শেষ করে, মেনু চাইল রঞ্জা।


মিক্সড কাবাবের কথা মনে পড়ল। এঁদের চাইনিজ আর নর্থ ইন্ডিয়ান- দুটোতেই বেশ সুনাম রয়েছে। চাইনিজ স্টার্টারও বেশ জমজমাট। মেনুতে যে সব লিস্টি, গোগ্রাসে তা পড়তে পড়তে মিক্সড কাবাবের-ই অর্ডার দিলাম। ঝিলমিল উৎসব চোখে রঞ্জা একটু কাছে সরে এসে বসল। টেবিলে রাখা একটা হাত মুঠোয় তুলে নিয়ে বলল,


- এই জয়েন্টে কেন এত যাদবপুরের লোকজন আসে জানো ফকির?


- প্রথমত কম খরচ। লোকেশন আর খাবারের মান ভাল হওয়ার কারণেও খুব জনপ্রিয় তন্দুর পার্ক। এবং একইসঙ্গে হল্লাবাজ ও নিভৃতে মন দেওয়া-নেওয়ার জয়েন্ট!


- ঠিক। খুব সত্যি কথা। এখানে বসেই যাদবপুর ক্যাম্পাসের কত প্রেম যে দীর্ঘজীবী হল। যুগলে যুগলে কত কানাকানি। ভেঙে চুরমার কত!


- তোমার হৃদয়ে পৌছোবার পথ বড় দীর্ঘ-/ যেতে যেতে সমস্ত জীবন কেটে গেল।


- বাজে কবিতা। খুব খারাপ। যা-তা!


- সুজিত সরকার যা-তা?


- শোনো তবে… যা বলতে চাইছ- তার জবাব শোনো শঙ্খ ঘোষে। ‘সঙ্গিনী : মূর্খ বড়ো সামাজিক নয়’। হাতের উপর হাত রাখা সহজ নয়/ সারা জীবন বইতে পারা সহজ নয়/ এ কথা খুব সহজ, কিন্তু কে না জানে/ সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়।


- আরিব্বাস। এটা তো দারুণ। ভেঙে চুরমারের পর এটাই যায়! এই জন্য তুই-তুই!


- আমি-আমি কী?


- লোলো একটা! ফকিরের আদরের ধন, পাগলি!


বাইরে ফের কি বৃষ্টি এল অন্ধকারে? মেঘ ডাকছে। ডাকুক। রাতভর বৃষ্টি হবে আজ। ওয়েটার দুটো বিপি লার্জ রিপিট করে গেল। ঠোঁট ডুবিয়ে বললাম,


- ইদানিং জেইউ-এর সেই রাশটা এখানে নেই রঞ্জা। নেই মানে, ক্যাম্পাসের কাছেই তো একাধিক ঠেক গড়ে উঠেছে। পার্ক স্ট্রিট বা বাইপাসে পাড়ি জমাচ্ছেন কেউ কেউ। একটা বড় অংশ সাউথসিটি-নন্দনে।


কথার মাঝে এল মিক্সড কাবাব। এখানে এলে রঞ্জাবতীর প্রিয় ডিশ। দিব্য খুশি মেয়ে। যেখানে বসেছি, সেখান থেকে দারুশালার সম্ভ্রান্ত সেলারটা নজরে আসছে। নানা পানীয়ের বোতলে ঠিকরে পড়ছে আলো। বার টেন্ডার মাতোয়ারা হয়ে পেগ সাজচ্ছে। চোখ গেল তন্দুর পার্কের ফ্যামিলি জোনে, বেশ নিরিবিলি।


- লোকজনের আসার এটাও একটা কারণ। একসঙ্গে দুটো জোনকেই পায়।


রঞ্জার কথার সমর্থনে বললাম,


- এই শহরের বহু পানশালায় এখন এই ব্যবস্থা। তুমি ঠিক-ই বলেছ। এতে উইকএন্ডে বলো, কোনও ছোটখাটো ফ্যামিলি গেট টুগেদারে জনতাকে ছুটোছুটি করতে হয় না। শুধু সপরিবারে এসে পড়লেই হল।


বিল দিয়ে যখন উঠছি, মনে হল রঞ্জার পা যেন টলে গেল একটু। বাইরে এসে দু’জনেই আনন্দে দিশেহারা। তুমুল বৃষ্টি নেমেছে ফের। চরাচরের আকাশ ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎরেখার তরবারিতে। রঞ্জাকে জড়িয়ে ভিজতে ভিজতে হাঁটতে ইচ্ছে করল। হাঁটছি। ওর ভিজে চুল, ঠোঁট থেকে চিবুকে গড়িয়ে পড়া বারিধারা, ভিজে শরীরের সুঘ্রাণে নেশা চড়ছে ফকিরের। নেশায় বুঁদ শনিবারিয়া নিশি!


ক্রমশ…

0 comments:

Post a Comment

" কিছু স্বপ্ন আকাশের দূর নীলিমাক ছুয়ে যায়, কিছু স্বপ্ন অজানা দূরদিগন্তে হারায়, কিছু স্বপ্ন সাগরের উত্তাল ঢেউ-এ ভেসে যায়, আর কিছু স্বপ্ন বুকের ঘহিনে কেদে বেড়ায়, তবুও কি স্বপ্ন দেখা থেমে যায় ? " সবার স্বপ্নগুলো সত্যি হোক এই শুভো প্রার্থনা!