ডাক্তারি ভাষায় প্রেম-ভালোবাসা


ভালোবাসা কিংবা প্রেম -এই শব্দগুলোর মধ্যে জড়িয়ে থাকে আবেগ-অনুভূতি-দায়িত্ববোধ এবং বিশ্বাস। একজন আরেকজনকে দেখলেই পুলকিত হয়। বুকের ভেতর ধড়ফড় করা কিংবা মানুষটির জন্য অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে। গল্পে-সাহিত্যে ভালোবাসা কিংবা প্রেমের নানান সংজ্ঞা রয়েছে। তবে ডাক্তারি ভাষায়ও কিন্তু প্রেমের নানান তথ্য রয়েছে। মানব-মানবীর প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে কথা বলেছেন মনোরোগ ও যৌন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব।


প্রশ্ন : ডাক্তারি ভাষায় প্রেমটা কী?

উত্তর : প্রেম হচ্ছে দুটি বিন্দুর মধ্যে আকর্ষণ। সেটা মানব-মানবী হতে পারে আবার অন্য জিনিসের প্রতিও মানুষের প্রেম হতে পারে। প্রেমের আবেদনটা শুধু ভিন্ন থাকবে। মানব-মানবীর প্রেমের মধ্যে জেন্ডার ফিলিং থাকে। এই জেন্ডার ফিলিংটা হচ্ছে প্রেমের পূর্বশর্ত। যেমন- তাকে দেখামাত্রই আবেগাপ্লুত হওয়া, বুকে চাবুক মারা, চলে যাওয়ার পর মনে পড়া। এই জেন্ডার ফিলিং-এ আকুতি থাকবে। মানুষটাকে দেখার জন্য পীড়া দিবে।

প্রশ্ন : একজন মানুষ আরেকজন মানুষের প্রতি ভালোবাসার ডাক্তারি ব্যাখ্যা বলুন-

উত্তর : আমরা যদি ভয় পাই তাহলে যেমন হরমোন নি:সরণ হয় তেমনি কারো প্রতি ভালোলাগা তৈরি হলেও হরমোন নি:সরণ হয়। মানুষের শরীরে ‘ডপামিন’ নামক একটা জায়গা আছে। যেটা সকল আনন্দের মূল জায়গা। ক্ষুধা লাগার পর ভাত খেলে যেমনি আনন্দ লাগে। প্রিয় মানুষকে চুমু খেলে যেমন আনন্দ লাগে তেমনি প্রিয় মানুষের কাছে গেলেও আনন্দ লাগে। এই ডপামিন-ই ভালোবাসার ভালোলাগা পেতে শুরু করে। ফলে সে আরো চায়। কারণ ডপামিন সকল আনন্দের জায়গা, ঘুম, সেক্স, রিল্যাক্স মানে যত ধরনের আনন্দের জিনিস আছে তার প্রত্যেকটির মধ্যেই ডপামিন জড়িত থাকে।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মানুষের নার্ভস-এ দুটি সিস্টেম রয়েছে। একটি হচ্ছে সোমাটিক ও অন্যটি অটোমেটিক। সোমাটিক হচ্ছে- ইচ্ছে করে করার বিষয়গুলো। যেমন হাঁটা-চলা ইত্যাদি। আর অটোমেটিক হচ্ছে ইমারজেন্সি কাজ। তবে এরমধ্যেও ভাগ আছে। একটি হলো সিমোপেটিক ও অন্যটি প্যারাসিমোপেটিক। এর দুটোই অটো কাজ করে। তবে ভালোবাসা কিংবা আনন্দের সব ঘটনাই ঘটে প্যারাসিমোপেটিক থেকে। ঘুম, সেক্স, খেলাধুলা -মানে যাবতীয় আনন্দের ঘটনা এর মাধ্যমেই হয়। কাউকে দেখলাম ভালো লাগলো, সেও তাকাল বুকে ধড়ফড় শুরু হলো এবং আবার তাকে দেখার জন্য অপেক্ষা - এমন ঘটনার জন্য সেই ডপামিন দায়ী। যা এই প্যারাসিমোপেটিকে অবস্থিত।

এখন এখানে একটা বিষয়ে বলা প্রয়োজন- প্রেমের যে ফিলিংস তা দেখা যায় একজন মানুষের প্রতিই হয়ে থাকে। তাকে নিয়েই সব কল্পনা এবং ভালো লাগা। কথা হচ্ছে এক জেন্ডার আরেক জেন্ডার-এর প্রতি আকর্ষণ হবে এবং যে কেউ যে কারো প্রতি ভালোবাসার সম্পর্ক হয় না কেন? এটা এখন পর্যন্ত কেউ আবিষ্কার করতে পারেনি। কোনো বিজ্ঞান এই প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হয়নি।

প্রশ্ন : প্রেম হলো আবার সে প্রেম ভেঙ্গেও গেল। অনেকে পারে তা মেনে নিতে আবার অনেকে তা পারে না। এই ক্ষেত্রে আপনি কি বলবেন-

উত্তর : মানসিক চাপ মোকাবিলা করতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের কোপিং স্ট্র্যাটেজি বা মানিয়ে নেওয়ার পদ্ধতি মানুষ অবলম্বন করে থাকে, যার কোনোটা গ্রহণযোগ্য, আবার কোনোটা অগ্রহণযোগ্য। অগ্রহণযোগ্য কোপিংগুলোর মধ্যে নিজের শরীরের সরাসরি ক্ষতি করা বা করার প্রবণতা অন্যতম। অতিরিক্ত ওষুধ খাওয়া, হাত-পা কাটা, শরীরের কোনো অংশ পুড়িয়ে ফেলা এসবের মধ্যে পড়ে। বিজ্ঞানসম্মতভাবে যাকে বলা হয়, ‘ডেলিবারেট সেল্ফ হার্ম’ বা ‘প্যারাসুইসাইড’।

আমাদের চারদিকের অনেক মানুষকেই আমরা জানি, যারা যখন-তখন হাত-পা কাটে, কথায় কথায় ঘুমের ওষুধ খায় কিংবা কখনো কখনো গায়ে আগুন পর্যন্ত ধরিয়ে দেয়। সত্যিকারের মৃত্যুচিন্তা বা আত্মহত্যার চিন্তা এখানে না থাকলেও কখনো এর পরিণতি মৃত্যু পর্যন্ত গড়াতে পারে।

কোনো একটি ঘটনা, পরিবেশ বা পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়া হিসেবে মানুষ যে কাজটি কারে বা করতে অভ্যস্ত হয়, সেটাই আসলে কোপিং বা কোপিং স্ট্র্যাটেজি। অজান্তেই এই প্রতিক্রিয়াগুলোতে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে যায়, যা সামাজিক, পারিবারিক, ধর্মীয় বা বৈজ্ঞানিকভাবে গ্রহণযোগ্য বা অগ্রহণযোগ্য দুই ধরনেরই হতে পারে। ধরুন, কেউ একজন পরীক্ষায় ফেল করল, তখন তার মন খারাপ হলো এবং ঠিক করল আমি আর লেখাপড়া করব না। এখানে লেখাপড়া না করার চিন্তাটি তাকে মন খারাপ হওয়ার বিষয়টি থেকে মুক্তি দিতে পারে। কিন্তু এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য প্রতিক্রিয়া নয়। আবার পাস করার আনন্দে যদি কেউ নেশাদ্রব্য গ্রহণ করতে চায়, সেটিও গ্রহণযোগ্য নয়। ডেলিবারেট সেল্ফ হার্মও একটি কোপিং স্ট্র্যাটেজি, যা নির্দিষ্ট কোনো ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে মানুষ করে থাকে। সাময়িক মুক্তি দেয় বলে অনেকে দাবি করলেও বাস্তবে তার ফল হয় উল্টো এবং অবশ্যই এটি একটি অগ্রহণযোগ্য কোপিং স্ট্র্যাটেজি।

প্রশ্ন : কারা ডেলিবারেট সেল্ফ হার্ম করে?

উত্তর : অপেক্ষাকৃত কম বয়সীদের মধ্যে এ প্রতিক্রিয়া বেশি দেখা যায়। ১৫ থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত বয়সীদের মধ্যে বেশি থাকে এবং ৩০ বছরের পর থেকে ধীরে ধীরে এ প্রবণতা কমে আসে। তবে কারো কারো মধ্যে সব সময়ই এ প্রবণতা থাকতে পারে। একটি তথ্য এখানে গুরুত্বপূর্ণ, ৯০ শতাংশের মধ্যেই কোনো না কোনো মানসিক সমস্যা থাকে। আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ঘটনার আগের ছয় মাস অন্তত চারগুণ বেশি মানসিক চাপের মধ্যে থাকে তারা। যেসব পরিবারে সঠিক দিকনির্দেশনা ও সঠিক মূল্যবোধের শিক্ষা কম, সেখানেই এসব বেশি হয়।

প্রশ্ন : কেন করে?

উত্তর : কেউ কেউ মরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে করলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় অন্যের মনোযোগ আকর্ষণই এর বড় কারণ। অপছন্দনীয় পরিস্থিতি থেকে মুক্তি কিংবা অন্যকে শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যেও অনেকে এ কাজ করে থাকে। আবার এর মাধ্যমে সাময়িক যন্ত্রণামুক্তির দাবিও করে কেউ কেউ।

প্রশ্ন : এর চিকিৎসা নিয়ে বলুন-

উত্তর : বখে যাওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকম নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এ সমস্যাকে দিন দিন আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা এদেরকে ভুল বুঝি। কিন্তু বিশেষ করে অভিভাবকদের এর পেছনের কারণ খুঁজে দেখতে হবে। নির্দিষ্ট মানসিক রোগের চিকিৎসা প্রয়োজন। অসহনীয় বা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রে নির্ভর করে তার নিজস্ব শিক্ষার ওপর। পরিবার, পরিবেশ বা সমাজ এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দুর্বল মানসিকতা বা অগ্রহণীয় কোপিংকে গ্রহণীয়তে রূপান্তর করাও চিকিৎসার অংশ। সর্বোপরি বিষয়টিকে হালকাভাবে না দেখে যথাযথ গুরুত্ব প্রদান ও সময়মতো সঠিক চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরি।

ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব : মনোরোগ ও যৌন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ, বি.এস.এম.এম.ইউ (পিজি), শাহবাগ, ঢাকা।

0 comments:

Post a Comment

" কিছু স্বপ্ন আকাশের দূর নীলিমাক ছুয়ে যায়, কিছু স্বপ্ন অজানা দূরদিগন্তে হারায়, কিছু স্বপ্ন সাগরের উত্তাল ঢেউ-এ ভেসে যায়, আর কিছু স্বপ্ন বুকের ঘহিনে কেদে বেড়ায়, তবুও কি স্বপ্ন দেখা থেমে যায় ? " সবার স্বপ্নগুলো সত্যি হোক এই শুভো প্রার্থনা!