নীরার পৃথিবী


চরম বিরক্তি নিয়ে মাথার উপর ঘুরতে থাকা ফ্যানটা দেখছে নীরা। গরুর গাড়ির চাকার সাথে অদ্ভুত একটা মিল আছে ফ্যানটার। গ্রামের রাস্তায় ধীর গতিতে ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করে যেভাবে গরু গাড়ি যায় ঠিক সেভাবেই ফ্যানটা ঘুরছে। কাজের কাজ তো কিছু হচ্ছেই না বরং গত এক ঘণ্টা ধরে উৎকট শব্দটা মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। এই মুহূর্তে বসে আছে সে খিলক্ষেত থানার ওয়েটিং রুমে। জীবনে প্রথমবার থানায় এসে ঠিক কি করবে বুঝতে পারছে না নীরা! এখন বাজে সাড়ে বারোটা, চৈত্রের খাড়া দুপুর। এক টায় কাব্য'র স্কুল ছুটি হবে। কাব্য প্লে'তে পড়ে, এই তো সামনের রোডেই ওর স্কুল। ওরা থাকে নিকুঞ্জ-১ এ আর কাব্য'র স্কুল নিকুঞ্জ-২। পাশাপাশি এলাকা, মাঝখানে এই থানা। তাই গাড়ি থাকা সত্ত্বেও প্রতিদিনই ছেলেকে নিজে স্কুলে নিয়ে যায়, নিয়ে আসে। থানাটা চোখে পড়লেও তাকে যে এভাবে এসে বসে থাকতে হবে কখনো কল্পনাও করেনি সে! কেমন যেন একটা ঘোর লাগা স্বপ্নের মধ্যে আছে সে! তাইতো হ্যাংলা পাতলা পুলিশটার কর্কশ ডাক একটু দেরিতে ঢুকল ওর কানে,

: এই যে আপা! আপা! ও আপা! শুনছেন?

: জি, বলেন।

: ডিউটি স্যার আপনারে ডাকে।

: ও আচ্ছা! এই তো আসছি...।

ডিউটি অফিসারের রুমে ঢুকে লোকটাকে দেখেই পছন্দ হয়নি নীরার। হোঁৎকা একটা ভুড়ি নিয়ে গোল গোল চোখ করে ওর দিকে দেখছে লোকটা। মুখ ভর্তি পান, কেমন অস্বস্তিকর! চেয়ারটা টেনে বসতেই ঠোঁটের বাম কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়া কষটুকু সুরুত করে টান দিয়ে বললো,

: জি ম্যাডাম বলেন, আপনার কি সমস্যা?

: আমার বাসা এই সামনেই, নিকুঞ্জ-১ এ। আমার ছেলের স্কুল নিকুঞ্জ-১ এ। আমি নিজেই প্রতিদিন আমার বাচ্চাকে আনা-নেওয়া করি। আজকেও সেরকম যাচ্ছিলাম। শপিং এর জন্য আজকে অবশ্য একটু আগেই বেরিয়ে ছিলাম। তো শপিং মলের কাছাকাছি যেতেই ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা ছেলে আমাকে আজে-বাজে, নোংরা কথা বলেছে!

: তো কি করতে হবে?

: কি করতে হবে মানে? আপনারা ব্যাবস্থা নিবেন!

: আচ্ছা, তা কি ধরনের আজেবাজে কথা বলেছে?

: মানে?

: মানে কি আজেবাজে কথা বলেছে?

: সেটা কোনও ভদ্র মানুষের পক্ষে মুখে বলা সম্ভব না!

: তাহলে লিখে দিন! একটা সিস্টেম আছে তো ম্যাডাম!

: আপনি জানেন, ওরা আমার গায়ে হাত দাওয়ার চেষ্টা করেছে!

: তাহলে কোথায় কোথায় হাত দিয়েছে সেটাও লিখে দিন! আপনার লিখিত অভিযোগ পেলেই আমরা আইন অনুযায়ী ব্যাবস্থা নিবো। আর শুধু অভিযোগ দিলেই হবে না, আপনার বাসার ঠিকানা, মোবাইল নাম্বার, স্বামী অথবা বাবার মোবাইল নাম্বার এ গুলাও লাগবে। দরকার পড়লে আমরা যেন যোগাযোগ করতে পারি। আইনের কাছে সব কিছুর ডকুমেন্ট দরকার, বুঝেন না কেন আপনারা!

ডিউটি অফিসারের কথা শুনে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো নীরা! কারন স্বামী বা বাবা কারো নাম্বারই দিতে পারবে না সে! কোন ভাবে এই কথা যদি একবার ওর হাজব্যান্ড কামালের কানে যায় তাহলে বিশাল বিপদ! সব দোষ ওর ঘাড়ে পড়বে! অপমান অপদস্থের শেষ থাকবে না! এমনিতেই কাব্যকে স্কুলে আনা-নেওয়া ছাড়া নীরার সেরকম বাইরে যাওয়া হয় না। কাব্য'র বাবা ওর বাইরে যাওয়া মোটেই পচ্ছন্দ করে না। সব সময় সন্দেহ করে ওকে। আর এ ধরনের কথা শুনলে তো প্রথমেই বলবে, তুমি নিশ্চয় আগে কিছু বলেছো!

কামালের সাথে আমার যখন বিয়ে হয় তখন আমার বয়স কেবল ১৭ আর ওর ৪১! বয়সের এত বিশাল পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ধনী, উচ্চ বংশীয় ব্যাবসায়ী পাত্র পেয়ে হাত ছাড়া করেননি বাবা। তাই অমত থাকা সত্ত্বেও বিয়ে করতে হয়েছে। বিয়ের পর মাস খানেক সব ঠিকই ছিল। কিন্তু তারপর থেকেই ও কেমন যেন বদলে যেতে শুরু করলো! বাচ্চা নেওয়ার জন্য জোর শুরু করলো! সব সময় খারাপ ব্যাবহার করতো, সন্দেহ করতো! এক পর্যায়ে গায়ে হাত দাওয়া শুরু করলো! আর সব চেয়ে আশ্চর্য হলো সব কিছুই কামালের কল্পনা! বাস্তবে নীরা এমন কিছুই করেনি যার জন্য কামাল এরকম করছে!

বেশ কয়েক বার মানসিক ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা বলে মার খেয়েছে নীরা। তারপর আর কিছু বলে না। মুখ বুজে সব সহ্য করে! অনেক বার ভেবেছে চলে যাবে সে! কিন্তু একমাত্র ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে যেতে পারেনি! আবার ছেলেকে নিয়ে যদি সে আলাদাও হয়ে যায় তাহলে যাবে কোথায়? বাবার বাড়িতে ঠাই হবে না নিশ্চিত, নিজেও কোথাও চাকরি করে খরচ চালাতে পারবে না! কারন পড়ালেখাটা শেষ করতে পারেনি সে বিয়ের পর। কারো সিভিতে শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচ এস সি সেকেন্ড ইয়ার লেখা থাকলে আজ কালকার যুগে চাকরি পাওয়া কল্পনা করাও সম্ভব না! আসলে নীরার কোন উপায় নাই, কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই!

ধুর! এতক্ষণ ধরে কি সব ভাবছে নীরা! একটা বেজে ৭ মিনিট পার হয়ে গেছে, কাব্য'র স্কুল ছুটি হয়ে গেছে! ছেলেটা হয়তো এতক্ষণ গেটে দাঁড়িয়ে মায়ের জন্য কাঁদছে! উঠে দাঁড়ালো সে চেয়ার থেকে,

: কি হল ম্যাডাম? দাঁড়িয়ে গেলেন যে! অভিযোগ করবেন না?

: না, থাক! ধন্যবাদ!

: আশ্চর্য! আপনাদের জন্যই তো আমরা কোনও ব্যাবস্থা নিতে পারি না! একবার অভিযোগ দিয়েই দেখেন আমরা কি করি! তা না, শুধু শুধু সময় নষ্ট করলেন আমার! আর কিছু বলবেন?

: না, আমি আসি।

বলেই আর এক মুহূর্তও দাঁড়িয়ে থাকলো না নীরা! ছেলের উদ্বিগ্ন মুখ চিন্তা করে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো....।

উপরের ঘটনা ও চরিত্র গুলো কাল্পনিক হলেও এরকম শত শত নীরা প্রতিদিন অমানবিক শারিরিক ও মানসিক নির্যাতন সয়ে শুধু মাত্র সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে সংসার আঁকড়ে ধরে অসহায় ভাবে বেঁচে আছে! এই নীরাদের কোন অভিযোগ জানাতে নেই, এই নীরাদের কৈশোরের পর তারুণ্য আসে না, এই নীরারা খোপায় কদম ফুল দিয়ে বর্ষার দিনে রিকশায় ঘুরতে পারে না, এই নীরারা শীতের রাতে একটু খানি উষ্ণতার জন্য কাউকে জড়িয়ে ধরতে পারে না, আইন এদের নিরাপত্তা দিতে পারে না, রাষ্ট্র এদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে না! নীরাদের পৃথিবী একটু বেশীই নিষ্ঠুর!

0 comments:

Post a Comment

" কিছু স্বপ্ন আকাশের দূর নীলিমাক ছুয়ে যায়, কিছু স্বপ্ন অজানা দূরদিগন্তে হারায়, কিছু স্বপ্ন সাগরের উত্তাল ঢেউ-এ ভেসে যায়, আর কিছু স্বপ্ন বুকের ঘহিনে কেদে বেড়ায়, তবুও কি স্বপ্ন দেখা থেমে যায় ? " সবার স্বপ্নগুলো সত্যি হোক এই শুভো প্রার্থনা!