পাহাড়ি কন্যা


একটা মানুষের চেহারা, যদি হয় অপূর্ব লাবণ্যের প্রতীক, আর সে মানুষটা যদি হয় নারী, তাহলে তো মহাভাগ্যবতী! আবার মাঝে মাঝে সে লাবণ্যময়ী চেহারা নারীর জীবনে ভয়ে আনে কালো অধ্যায়। আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে আমি তেমনি একজন আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী মেয়ে। পাহাড় থেকে সমতল ভূমিতে আমি কখনো আসিনি। পরিবারের দুঃখ কষ্টের দিকে তাকিয়ে একটা এনজিওতে শিক্ষক কার্যক্রমে চাকুরী নিই। শৈশবে আমার দিনগুলো কেটেছে নাচ গান আনন্দ উৎসবে স্বতঃর্স্ফুত ভাবে অংশগ্রহণ করে। পাহাড়ি মেয়ে তাই পাহাড়কে আমি মন-প্রাণ উজাড় করে প্রেমিক হিসেবে বুকে স্থান দিয়েছি। পাহাড়ের ঝর্ণায় অবাধ সাতার কেটেছি। অরণ্যের ফুল দিয়ে মালা গেঁথেছি, সেই মালা কুপায় বেধে ‘ছিমুই পাইংখইং তম্রইং ম্রইং

অক্যোয়াইংরোহ থংমা হিয়াহলে’ গান গেয়ে আনন্দে নেচেছি। সেই দিনগুলোর কথা স্মৃতিপটে মনে হলেই চোখ হয়ে যায় অশ্রু নদী, হৃদয় হয়ে যায় তবিত, তখন সুখ ছিল আদিবাসী গ্রামে। অন্যরকম সুখ। ছোট ছোট গ্রাম, ছোট ছোট সুখ। তখন সমাজে শোষণ বঞ্চনা ছিলনা। শোষণ বঞ্চনার অর্থই আমরা জানতাম না। মানুষকে অবিশ্বাস, সন্দেহ করা তো চিরকাল পাপ বলেই জেনেছি, আর সারা জীবন ঠকেছি সন্দেহীনতার জন্য।

কিন্তু আজ অরণ্য নেই, আদিবাসীদের সে জীবনও নেই। পাহাড় ঠিকই আছে, কিন্তু পাহাড়ের ওপর আমাদের অধিকার নেই। সব হারিয়ে আজ আমরা অসহায়, বিপন্ন। হঠাৎ সমতল ভূমির হায়েনারা এসে আমার প্রেমিক পাহাড়কে ছিনতাই করে নিয়ে গেল। আমাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিল। পাহাড়ের ভেতর যখন বাইরের মানুষের অনুপ্রবেশ ঘটে তখন পাহাড়ি জীবন হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। কেননা ভালোবেসে, ভালো মন নিয়ে তো আসেনি পাহাড় দেশে কোনো বাইরের লোক। আমি খুব কষ্ট করে আইএ পাশ করি। আমার পরিবারের সবাই অশিক্ষিত। আমরা খুবই গরীব। বাবা ভ্যান চালক। চাকুরী নেবার আগে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে লেখা ছিল আদিবাসী মেয়েদের অগ্রাধিকার ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে। কিন্তু চাকুরি নিয়ে দেখি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্তগুলোর একটাও মানা হচ্ছে না। চাকুরিতে কত ট্রেনিং করেছি, ট্রেইনার কত ভালো ভালো কথা বলেছে- কিন্তু সেগুলো ছিল কথার ফুলঝুরি মাত্র।

চাকুরি নিয়ে আমাদের সংসারের কিছু পরিবর্তন এসেছে বটে, কিন্তু আমার হৃদয় তবিত করে দিয়েছে তথাকথিত শিতি মুখোশধারীরা। অফিসে সুযোগ পেলেই বাঙ্গালি বড়কর্তা, ছোট কর্তা এমনকী আমার সহকর্মীরা বিভিন্ন ভাবে নির্যাতন করত। ওরা মুখে মানবাধিকারের কথা বলত। নারীর মতায়ন, আদিবাসীদের অধিকারের কথা বলত। কিন্তু মনে প্রাণে ওরা ছিল ওসবের বিরুদ্ধে। একদিন শুনলাম ময়মনসিংহ থেকে একজন বাঙালী মুসলমান আমাদের অফিসে বদলি হয়ে আসছেন। ভয়ে আরো আতংকিত হলাম। যথা সময়ে সে আসল। তাঁর কথা বার্তা চালচলনে আমি অবাক হলাম।

একদিন অফিসে মিটিং হচ্ছে। বস আমাকে বললেন, তুমি বেলালকে নিয়ে ষ্টোর রুম থেকে বই নিয়ে এস। আমি না বললাম। একে একে আরো কয়েক জনের নাম বলল, আমি না উত্তরই দিলাম। বস হঠাৎ রাগে বললেন- তাহলে ময়মনসিংগ্যা মদনটার সঙ্গে যাবে। আমি হ্যাঁ বললাম। দু’জনে ষ্টোর রুমে ঢুকলাম। প্রায় এক ঘন্টা খুঁজে বই পেলাম। কিন্তু বসের সেই ময়মনসিংগ্যা মদনটার কাছ থেকে সেদিন যে ব্যবহার পেয়েছি, মনে হল ও যে দ্বিতীয় ভগবান বৌদ্ধ। ভগবান বৌদ্ধের মতোই ছিল দাদার স্বভাব। আমার একদম বিশ্বাস হতো না তিনি বাঙালি। আমাকে সবসময় ছায়ার মতো আগলে রাখতেন। তার সততা ও বিশ্বস্তায় আমি মুগ্ধ হয়েছি। তিনি প্রায়ই বলতেন- ‘মানুষের মৃত্যু আমাকে আঘাত করে না, কিন্তু মনুষ্যত্বের মৃত্যুকে আমি সইতে পারি না।’ হঠাৎ একদিন বলে ফেললাম -এটা কী অপনার মতামত। দাদা বললেন-‘শরৎ বাবুর’।

দাদা কম কথা বলতে ভালবাসে। চিৎকার চেচাঁমেচি একদম পছন্দ করেন না। তিনি আবার মাঝে মাধ্যে গুন গুন করে গান গায়। গানের স্বর খুবই মিষ্টি। পুরোটা গেয়ে কখনও শেষ করেন না। ওই টুকু শুনলেই মন হারিয়ে যায় কোন অজানা দ্বীপে। একদিন দাদাকে বললাম আপনি কি শিল্পী ?  তিনি কিছুণ চুপ থাকলেন। তারপর হঠাৎ ‘ও নদীরে একটি কথা ............’ মনে হলো হেমন্তের গান। আমি যেন জুবুযুবু হয়ে দাঁড়িয়ে অজর ধারায় বৃষ্টির পানিতে সাংগু নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছি। কয়েকটা লাইন গাওয়ার পর থেমে গিয়ে বললেন- গাইবা, সময় হলো।

 প্রায়ই অফিসের কার্যক্রম দেখে আমার কষ্টে চোখ ফেটে জল আসতো। মনে মনে ভাবতাম- ‘আদিবাসীদের নিয়ে সরকারের প্রতারণা দেখেছি। এবার দেখলাম এনজিওদের প্রতারণা। একদিন খবর আসলো আমার বাবা ভীষণ অসুস্থ। বসের কাছে এসে ছুটি চাইলাম। বাবার অসুস্থার কথা বললাম, কিন্তু তিনি ছুটি দেননি। ময়মনসিংগ্যা দাদাটা অসুস্থতার কথা শুনে সাথে সাথেই বান্দরবান চলে গেল। নিজের টাকা খরচ করে আমার বাবাকে সুস্থ করে তুলল। আমি বিষয়টা হেড অফিসকে জানালাম। তার কিছুই হলনা। বরং হেড অফিস সেই বসকে প্রমোশন দিল। এবার আরেক নতুন বস আসল। তার ব্যবহারে মনে হল জলন্ত আগুন থেকে মুক্ত হয়ে ফুটন্ত কড়াইয়ের মধ্যে পড়ে গেলাম। আমার দিকে যখন চাইত তখন মনে হতো আমার সারা শরীর গিলে খেতে চায় ? আমাকে অনেক উক্ত্যক্ত করতে লাগল। হেড অফিসের নিয়ম আছে মেয়েদের মাসিকের সময় ফিল্ডে কাজ নিষিদ্ধ। কিন্তু সে সময় আমাকে ফিল্ডে কাজ করতে হতো। অফিসে পাঁচটার পর কাজ নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু কাজ থাকুক কিংবা না থাকুক দশটা পর্যন্ত অফিসে বসিয়ে রাখতেন।

ময়মনসিংগ্যা দাদা এ সবের প্রতিবাদ করায় একদিন তার চাকুরী চলে গেল। আমি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়লাম। কী করবো বুঝে উঠতে পারলাম না। দাদাকে মোবাইল করলাম দাদা চাকুরী ছাড়তে নিষেধ করল। আমার বাবা আবার অসুস্থ হল। ছুটি চাইলাম। বস আমার সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করলো। আমি রিজাইন লেটার লিখে বান্দরবান চলে এলাম। এসে দেখি বাবার লাশ উঠানে, সেখানে অনেক মানুষের ভীড়। অবাক চোখে চেয়ে দেখলাম ময়মনসিংগ্যা দাদাটা নির্বাক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে বাবার লাশ পাহারা দিচ্ছে।

বেশ কয়েকদিন ধরে দাদাকে নিয়ে গ্রামে কথা উঠতে থাকলো। এমননিতেই এক করুন হতাশার ঝড় বইছে বুকের ভেতর। তাই এসব কথাবার্তার কোনো পাত্তা দিলাম না। একদিন সকালে অবসন্ন শরীর নিয়ে হাঁটছি। তখনও সূর্য উঠেনি। রাস্তায় লোকজনের চলাচল কম। আমাদের বাড়িটি তখনও জেড়ে উঠেনি। হঠাৎ চেয়ে দেখি গ্রামের রোয়াজা (গ্রাম প্রধান) আমাকে বলছেন - বুলবুলি তুমি আত্ম মর্যাদা বলে কিচুই কী শিখনি? তোমার বাবা তোমাকে কি শিা দিয়েগেছেন। সবই কী ব্যর্থ ? সমাজের কাছে আমি কী জবাব দেব ? লজ্জা করে না বাঙালি মুসলমানকে বাড়ীতে রাখতে? আমি চোখ বন্ধ করে বিনম্রভাবে বললাম - সে ও যে মানুষ।

ভগবান বৌদ্ধের কাছে জাত ধর্ম বলে কিছুই নেই। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল বাবার বন্ধু জিতু কাকু। তিনি আমাদের ধর্মীয় ভিক্ষু। বাবার সংগে তাঁর ছিল ভীষন ভাব। সবাই তাকে সম্মান করে। তিনি বললেন আমাদের ধর্ম আছে, মান আছে, জাত আছে, নাই শুধু মানুষের ভালবাসা। নাই শুধু দিব্য চোখ। যা দিয়ে তুমি বাস্তব পৃথিবীকে দেখতে পার। সত্যকে মেনে নিতে পারো। হ্যাঁ তোমার দাদা যদি তিনটি কাজ করতে পারে তাহলে তোমার দাদাকে মুক্তি দেব।

আমি বললাম - কী কাজ ?

তিনি বললেন প্রথম কাজ হল আগামীতে যে সাংগ্রাই উৎসব হবে, আজ থেকে চাঁদা উঠানো হবে। যে যত টাকা দেবে টাকার নম্বর সহ আমি লিখে রাখব। তারপর থলের ভেতর নম্বর সহ টাকা গুলো পেকেট করে বাবুর নিকট জমা রাখা হবে। কোন ভাবেই বলা যাবে না থলে নম্বর সহ টাকা আছে। সেই থলে তিন মাস পর ফেরত চাইব। টাকা সহ থলে ফেরত দিলে মনে করবো তিনি মানুষ।

তারপর সব গুলো টাকার নম্বর এক এক করে মেলাবো, টাকার নম্বর মিললে মনে করবো তিনি মানুষের মধ্যে ভালো। দ্বিতীয় পরীাটা হবে - সাংগ্রাই অনুষ্ঠানে আমাদের ভাষার তিনটি ও তাদের ভাষার তিনটি তিনটি করে মোট ছয়টা গান গাইতে হবে। তিন নম্বর পরীক্ষাটা খুব বিপদজনক। সেটা হল আগামী নবান্ন উৎসবে আমাদের সম্প্রদায়ের ২১ জন গানের এবং নাচের শিল্পীকে নিয়ে দূর্গাপুর বিরিশিরি কালাচারাল একাডেমীতে যেতে হবে। সংগে শুধু বাবু যাবেন। ওই পরীক্ষা গুলোতে উর্ত্তীণ হতে পারলেই তোমার দাদাবাবু কে আমরা স্বসম্মানে মুক্তিদেব। মনে রেখ - এ ব্যাপারে বাবুর সংগে তোমার কোন গোপন কথা চলবেনা। আজ থেকে তোমার পেছনে আমাদের কড়া নজর থাকবে।

আমি ভাবতাম - দাদা বাবু সব কাজই পারবেন কিন্তু আদিবাসী গান গাইতে পারবেন না। কারণ তার মুখে তো কখনও আদিবাসী গান শুনিনি। আর আমার ভয় বাড়তে থাকলো। দাদা কী পারবে ? এরই মধ্যে সাংগ্রাই অনুষ্ঠান এসে গেল। সবার মধ্যে একটা আনন্দ উদ্দিপনার ভাব দেখা গেল। চমৎকার ভাবে সাজানো হল মঞ্চ, আধুনিক আলোকসজ্জা। আমি কোন মতে ভয়ে ভয়ে মাঝামাঝি জায়গায় একটা আসনে বসে গেলাম। দাদা তিনটা আদিবাসী গান গাইলেন। দাদার গান শেষ হতেই লোকজনের চেঁচামেচি ওয়ান মোর, ওয়ান মোর। তারপর অদ্ভুত সুন্দর করে গাইলেন বাঙালি তিনটা গান। আবার চেঁচামেচি ওয়ান মোর, ওয়ান মোর। দাদা আর গাইলেন না। ওদিকে সাংগ্রাই অনুষ্ঠানের পুরো টাকা তিনমাসে দাদার কাছে যেভাবে রাখাহয়েছিল ঠিক সেইভাবে আমাদের সম্প্রদায়ের শ্রদ্ধেয় দায়িত্বপ্রাপ্তগন পেয়েছিল। আর ওদিকে আমার চোখে মুখে এক অজানা আনন্দ ছড়িয়ে পড়তে থাকল।

আমাদের গ্রামে আরেক উৎসবের আরেক আমেজ শুরু হল। ২১ জন মেয়ের রিহার্সাল। অর্ধেক সময় ধরে চলে যন্ত্রসংগীত। বাকি অর্ধেক সময় গান, নির্বাচিত ধরনের গান। হঠাৎ চেয়ে দেখি এক অদ্ভুত মোহনীয় সুরে একাত্ম হয়ে ওঠেছে গোটা পাহাড়ের প্রকৃতি। তারপর খুব অল্প সময়ের মধ্যে বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো মানুষ আসতে থাকল। এখন পাহাড়ে সবার মুখে মুখে দাদার প্রশংসা। তবে কয়েকজন বলাবলি করছে শুধু একজন বাঙালির ওপর ২১ জন আদিবাসী মেয়েকে ছেড়ে দেয়া যাবেনা। দাদা এবারও উত্তীর্ণ হলেন। বিরিশিরি থেকে প্রোগ্রাম করে সবাই ভালোভাবে এসেছে। গোপনে ২১ জনের সাক্ষাৎকার নেয়া হল। সবাই বলল - তিনি দ্বিতীয় গৌতম বৌদ্ধ। সবার ভুল ভাঙ্গল। এবার দাদার জন্ম দিবস পালন করতে চাইলাম। দাদা জন্মতারিখ বললেন না বরং তা পালন করতে নিষেধ করলেন। আমি খুব কষ্ট করে দাদার সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে ২ জানুয়ারী তা পালনের সিদ্ধান্ত নিই। সন্ধ্যায় কেককাটার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হল। আমাদের সম্প্রদায় ছাড়াও অন্যান্য আদিবাসীরাও আসলো। পুরো বাড়ি কানায় কানায় ভরে গেল। মানুষ শুধু বলতে থাকল গৌতম বৌদ্ধ না কি জীবন্ত হয়ে এসেছে ? এবার দাদাকে একটা গান গাইতে বললাম- দাদা সংগে সংগে গাইলেন-

একটি বীণাতার একটি সংসার

ভায়ের আদরের ছোট বোন.....

গানটি শেষ হতে না হতেই দাদা রক্ত বমি করতে করতে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়লেন। কী করুণ হয়ে উঠল চারপাশ। চারিদিকে জোছনা প্লাবিত কান্না ঝরানো রহস্যময় প্রকৃতি আমাকে আজীবনের জন্য স্তব্দ করে দিয়ে গেল।

0 comments:

Post a Comment

" কিছু স্বপ্ন আকাশের দূর নীলিমাক ছুয়ে যায়, কিছু স্বপ্ন অজানা দূরদিগন্তে হারায়, কিছু স্বপ্ন সাগরের উত্তাল ঢেউ-এ ভেসে যায়, আর কিছু স্বপ্ন বুকের ঘহিনে কেদে বেড়ায়, তবুও কি স্বপ্ন দেখা থেমে যায় ? " সবার স্বপ্নগুলো সত্যি হোক এই শুভো প্রার্থনা!