ডান পায়ের জুতোটা ছিড়ে গেছে । হাঁটতে গিয়ে টের পেলাম । এই যাহ্ ! এমনিতেই মাসের শেষ । তার উপর ২ দিন পর সুমির জন্মদিন । আমি ৩ টা টিউশন করে তার পড়ার খরচ চালাই । ঢাকা ভার্সিটিতে থার্ড ইয়ারে পড়ি । হলে থাকি । তাই সব মিলিয়ে একটু হিসেব করেই চলতে হয় ।
মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেদের যা হয় আর কি ?
সুমির সাথে পরিচয় হল ৫-৬ মাস হল । ফেসবুকে । প্রথম প্রথম নিয়মিত চ্যাট । তারপর সেল ফোনে মেসেজ আদান প্রদান । এরপর কথা বার্তা । ওই ফোন দিতো বেশি । আমি মোবাইল এ ফ্লেক্সি খুব কমই করতাম । হিসেব করে চলি তাই । কত রাত কেটে যেত কথা বলে বলে তার হিসেব নেই । একসময় বুঝতে পারলাম আমি সুমির প্রতি দুর্বল ।
হলের সামনের মুচি মামার কাছে জুতোটা সেলাই করতে নিয়ে গেলাম ।
মুচি মামা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, কি মামা ? আবার ছিঁড়ছে ?
আমি অপরাধির মত হাসলাম ।
দেন, সিলাইয়া দেই । একজোড়া নতুন জুতা কিনলেই পারেন । কি যে করেন ?
আমি মনে মনে বললাম, তুমি কি বুঝবে ? আমার খবর ? মানুষের বাইরে থেকে কি ভেতর বুঝা যায় ? আমার মত মানুষরা এভাবেই কষ্ট করে বড় হয় ।
জুতো সেলাই শেষে একটু আজিজ সুপার মার্কেট গেলাম । সুমির জন্য একটা চাদর কিনব । নিত্য উপহার থেকে । কালো রঙের । ও খুব ফরসা । সবরি কলার মত । আমি খুব কালো ।
মাঝে মাঝে আমি অবাক হই, ও কি দেখে আমায় ভালবাসল । আমি খুব সাধারন । একটা শার্ট ৩ দিন পরি । মাথার চুল এলেবেলে করে রাখি । ফ্যাশন করি না । করব কোথা থেকে ? আমার কাছেত টাকাই নেই ।
চাদর পছন্দ হচ্ছে না । খুব টেনশনে আছি । মাঝে মাঝে এমন হয় আমার । কিছুই মনে লাগে না ।
সুমির ফোন………
ইফতি কি করছ ?
এইতো কিছু না । একটা ফ্রেন্ড এর সাথে আজিজে আসছি ।
দুপুরে খেয়েছ ?
না। খাব । হলে গিয়ে ।
তুমি যে কবে মানুষ হবে ? এখনও খাও নি ? এরপর বিকেলে ফোন দিলে বলবে পেট ব্যথা ।
আমি যে এমন তুমিত জানই ।
হুম । শুন, পরশু আমার সাথে ঘুরতে বেরুবে । বিকেলে । আমি তোমার ওখানে আসব । মনে থাকবে ?
আচ্ছা । মনে রাখব ।
ওকে । এখন রাখি ।
মাঝে মাঝে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয়। সুমি এত কেয়ারিং ! আমাকে বেবিদের মত আগলে রাখতে চায় । ভালই লাগে । অবশেষে একটা চাদর পছন্দ হল । অনেক গুলো বিন্দু একসাথে ।
বাহ ! থিমটা পছন্দ হইসে ।
২ দিন পর। বিকেল ৫ টা ।
আমার কাঁধে একটা ব্যাগ । তাতে সুমির চাদর রাখা । ওর আজ জন্মদিন ।
আমি টি এস সি তে বসে আড্ডা দিচ্ছি। সমাজ, রাজনীতি নিয়ে জটিল বক্তব্য শুনছি, নিজেও মাঝে মাঝে দিচ্ছি । হথাত সুমির ফোন ।
এই যে মেঘ বালক, কই তুমি !
এইতো টি এস সি তে ।
আমি আসছি ৫ মিনিটের ভেতর ।
ওকে । আস ।
ঠিক ১০ মিনিটের মাথায় সুমি আসল । ওর সাদা ধবধবে গাড়িতে । নিজেই ড্রাইভ করে সে ।
ও আজ হলুদ শাড়ি পড়েছে । সাথে কালো ব্লাউজ । খোঁপা করা । একপাশে ফুল গোঁজা ।
আমাকে ইশারায় গাড়ির ভেতরে আসতে বলল ।
আমি বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওর গাড়ির কাছে গেলাম । ও দরজা খুলে বলল……
গাড়িতে উঠ ।
কই যাবে?
দেখি কই যাওয়া যায় তোমায় নিয়ে ।
আমি সুবোধ বালকের মত গাড়িতে উঠলাম ।
আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে আশুলিয়ার পথে । সুমি গান ছাড়ল । ভালো আছি ভালো থেক আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখ ।
ডান হাত দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে সুমি । ওর বাম হাত আমার হাত এ ।
আমি আমার ব্যাগ থেকে চাদর এর প্যাকেট খুলে ওর কাছে দিয়ে বললাম, হ্যাপি বার্থ ডে ।
ও সাথে সাথে গাড়িটা পাশের রাস্তায় পার্ক করল । ছোটো বাচ্চাদের মত প্যাকেট খুলে চাদরটা বের করল । ওয়াও । জটিল । আমি এখনি পরব ।
আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম । আমি জানি ও ব্র্যান্ড এর পোশাক ছাড়া কিছু পরে না ।
ও চাদরটা গায়ে জড়াল । আমাকে বলল,
এটা আমার জন্মদিনের শ্রেষ্ঠ গিফট ।
আমি থ্যাংকস বললাম ।
ও গাড়ি চালাচ্ছে । মাঝে মাঝে জোকস বলছে । আর হেসে কুটি কুটি হচ্ছে । আমিও খুব হাসছি ।
গাড়ি এখন আশুলিয়ায় ।
ও আর আমি গাড়ি থেকে নামলাম ।
দুজনে দাঁড়িয়ে আছি । গাড়িতে হেলান দিয়ে । আমি এমন ভাবে দাঁড়ালাম । যেন আমার ছেঁড়া জুতোগুলো ও দেখতে না পায় ।
ও আমার হাত ধরে বলল,
ইফতি, আমায় অনেক ভালবাস তুমি ?
হুম ।
আমি যদি কোনদিন না থাকি !
ফালতু কথা বল না । আমার রাগ লাগে ।
হা হা হা । তুমি আসলেই একটা পিচ্চি ।
তুমিও পিচ্চি ।
যাহ্ । আমি কেমন করে পিচ্চি হলাম। বলতো ?
আমি কিছু বললাম না । হাসলাম ।
সুমি হথাত করে বলল, ওহ ! ভুলেই গেসি । তোমার জন্য একটা গিফট ছিল ।
দাঁড়াও । এক মিনিট ।
ও গাড়ির পেছন থেকে একটা শপিং ব্যাগ বের করল ।
আমার হাত এ দিয়ে বলল, এটা তোমার জন্য ।
আমি দেখলাম, এক জোড়া এপেক্স এর জুতা ।
আমি ভেউ ভেউ করে কেঁদে দিলাম ।
সুমি তাড়াতাড়ি আমাকে তার বুকে জড়িয়ে ধরল।
এই সোনা ! তুমি কাদ কেন ? প্লিজ, শান্ত হও । প্লিজ ।
আমি কেদেই চলেছি । ওকে আঁকড়ে ধরে ।
আমি একটু শান্ত হয়ে বললাম, তুমি আমাকে এত ভালবাস কেন ?
ও আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, তোমায় ভালো লাগে তাই ।
আমায় কখনও ছেড়ে যেও না । আমি সত্যি মরে যাব ।
আদর আমার মুখ তুলে আমার ঠোঁটে তার ঠোঁট রাখে ।
আমার ঠোঁট, মন, হৃদয় ভিজতে থাকে ভালবাসায় আর আদরে ।
0 comments:
Post a Comment