“ভালোবাসা” এ চার অক্ষরের শব্দটি একেকজন মানুষের জীবনে একেকভাবে এসে থাকে ,আর একেকজন মানুষ একেকভাবে ভালোবেসে থাকে। কেউ প্রথম দর্শনে ভালোবাসে, কেউ ফোনের মাধ্যমে ভালোবাসার ইনিংস শুরু করে। কিন্তু তুরস্কের “Love Likes Coincidences" চলচ্চিত্রটি ভালোবাসার এ ধরণের যাবতীয় রসায়নের পথ অনুসরণ করেনি । নায়ক কিংবা নায়িকা কেউই জানেনা তাদের প্রথম দেখা কবে হয়েছে । কিন্তু এমন কি শুনেছেন কখনও যে আপনার প্রেমিকার সাথে আপনার দেখা হয়ে যাবে যখন আপনি মাতৃগর্ভে আছেন । ছবির গল্পের শুরুটা ঠিক এমনি ।অন্যরকম এক ভালোবাসার ছবি এটি ,যার গল্প অনেক টানবে চলচ্চিত্রপ্রেমিদের মনে । ইরানি মুভিগুলোর মত মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে তুরস্কের মুভিগুলোও ইদানীং অনেক ভালো হচ্ছে । তাদের গল্পশৈলী ও ছবি নির্মাণ কাঠামো দিন দিন অনেক ভালো হচ্ছে ,আর তার যথার্থ প্রমাণ এ চলচ্চিত্র । নুরান ইব্রেন সিতের কাহিনী অবলম্বনে ২০১১ তে মুক্তি পায় "Love Likes Coincidences" ছবিটি। আর ছবিটি পরিচালনা করেছেন – পরিচালক ওমর ফারুক সরাক।
গল্পের শুরুতে তখন পর্যন্ত নায়ক কিংবা নায়িকার কারোরই জন্ম হয়নি । তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই যে কিভাবে কোথায় কখন তাদের পরিচয় হবে।তাদের পরিচয় একবার কিংবা দু'বার হয়না, অনেকবার হয়। আর তাদের দেখা কিংবা পরিচয়গুলো ভিন্ন রকমের হয়। তাদের পরস্পরের অনেকবারই একসাথে দেখা হয়েছে ,কিন্তু সেটা কিভাবে? প্রথম দেখা নায়ক(ওযগার ) এবং নায়িকার(ডেনিজ)যখন তারা তাদের মাতৃগর্ভে।
১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বরের আনকারা শহরের এক সকাল, ইলমাজ খুব দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাচ্ছে তার প্রেগন্যান্ট স্ত্রী নেরিমানকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য কিন্তু ঠিক এমনই এক মুহূর্তে গাড়ি দুর্ঘটনা হয় তার গাড়ির সাথে ওমরের গাড়ির , যার গাড়িতে বসা ছিল ওমরের প্রেগন্যান্ট স্ত্রী। আর এ কারণে ওযগার এবং ডেনিজ এর মায়েদের হাসপাতালে একই সময়ে যেতে হয়, আর একই সময়ে হাসপাতালে জন্ম নেয় ওযগার এবং ডেনিজ। আর সেটাই হয় তাদের প্রথম পরিচয়।
ওযগারের বাবা একজন পেশাদার ফটোগ্রাফার। তার স্টুডিও আছে , যাতে বিভিন্ন মানুষ আসে তাদের ছবি তোলার জন্যে। সেখানেই ডেনিজের নানা ছোট ডেনিজকে নিয়ে আসে একদিন তার ছবি তোলার জন্যে। আর অনেকক্ষণ ধরে একটা হাসোজ্জ্বল ছবি তুলার জন্যে চেষ্টা করে ওযগারে ফটোগ্রাফার বাবা। কিন্তু চঞ্চল ডেনিজের হাসিমুখ ছবি ঠিকমত আসছিলনা। আর দুরন্ত ওযগার তার বাবার জন্যে খাওয়া নিয়ে আসে ঠিক ওই মুহূর্তে স্টুডিওতে। আর আচমকা তাকে দেখে একটা হাসি দেয় ডেনিজ। এ হচ্ছে তাদের দ্বিতীয় দেখা। এরপর প্রায় সময় রাস্তায় ডেনিজ দাঁড়িয়ে দেখতো ওযগারকে। ওযগার সাইকেল চালিয়ে যায় এবং আসে , আর তাকে দেখার জন্যে অপেক্ষায় থাকতো ডেনিজ। ছোটবেলার প্রেম যাকে বলা যায়। এভাবে অপেক্ষা করতে করতে ওযগারের সাইকেলের সামনে ডেনিজ এসে পড়লে তারা দুজনেই সামান্য আহত হয় এবং দুজনই একই হাসপাতালে চিকিৎসা নেয় । প্রতিবার যেন নতুনভাবে তাদের পরিচয় হাসপাতালে।
কাকতালীয়ভাবে ওযগারের সাথে ডেনিজের আবার দেখা হয় তরুণ বয়সে ,কিন্তু ডেনিজতো ভালোবাসে আরেকজনকে তাহলে ওযগারের কি হবে? কাহিনীর টুইস্ট শুরু পুরো গল্প জুড়ে।এক ছবি প্রদর্শনীতে ওযগার তার বাবার তোলা ছবিগুলো প্রদর্শনী করে, আর সেখানেই ডেনিজ তার ছোটবেলার ছবি দেখে এগিয়ে যায় আর এভাবে তাদের তরুণ বয়সে দেখা হয় এবং পরিচয় হয় আবার নতুনভাবে। এদিকে ডেনিজের অভিনয়ের প্রতি দারুণ নেশা। একটা থিয়েটারের হয়ে সে অভিনয় করে। আর ওযগারের সাথে তার যোগাযোগ কিংবা দেখা চলতে থাকে কিন্তু চলচ্চিত্রটি জুড়েই যেখানে কাকতালীয় সব ঘটনার আবর্তন হচ্ছে সেখানে তারা কিভাবে তাদেরকে নিজেদের জীবনে পাবে। এইরকম গল্পের ওপর নির্মিত হয়েছে তুরস্কের চলচ্চিত্র Love Likes Coincidences।
জীবনের বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন মোড়ে তাদের দেখা জীবনে বিভিন্নভাবে হয় কিন্তু শেষ পরিণতি কি?আর বার বার তাদের এই দেখা তাদের মাঝে কি কাকতালীয়ভাবে ভালোবাসার আবির্ভাব ঘটাচ্ছেনা? হয়ত তাই , এক এক মানুষের জীবনে হয়ত ভালোবাসা এক একভাবে ঘুরে ফিরে আসে , যাকে ভাবা হচ্ছে সে জীবন থেকে চলে যাচ্ছে হয়ত সেই মানুষটিই ঘুরে ফিরে আবার জীবনে দেখা দিবে নতুনভাবে নতুনরুপে। আর এই রকম কাকতালীয় ভালোবাসার গল্পইতো-"Love Likes Coincidences"।
"Love Likes Coincidences" ছবিতে অভিনয় করেছেন - মেহমেত গুনসুর , বেলসিম বিলজিন , আলটান ইরকেকলি সহ আরও অনেকে। ছবিতে ছবির দুই কেন্দ্রীয় চরিত্র মেহমেত গুনসুর ও বেলসিম বিলজিন চমৎকার কাজ দেখিয়েছেন। ছবিটির কাহিনী , দৃশ্যায়ন অনায়াসে যে কাউকে মুগ্ধ করবে।
চলচ্চিত্রটিতে কাকতালীয়ভাবে দেখা হওয়ার বিষয়গুলোতে এক চমৎকার ঐক্যতান ছিল। ছবির একটা দৃশ্যের সাথে আরেকটা দৃশ্য যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। যেখানে মনে হচ্ছিল পরিচয় হয়ে গেছে ঠিক সেখানেই গল্পের নায়ক-নায়িকা আবার হারিয়ে যাচ্ছে। কিছু স্মৃতি রোমান্থন , কিছু কষ্ট , কিছু আনন্দের মুহূর্ত যেন তাদের কাছে বারবার ঘুরে আসছিল। ক্যামেরায় চমৎকার দক্ষতা দেখানোর চেষ্টা দেখিয়েছেন পরিচালক। বিশেষ করে ছোটবেলায় যখন নায়ক তার বাবার সাথে এবং নায়িকা যখন তার নানার সাথে একই পার্কে ঘুরছিল তখন এক চমৎকার কাজ দেখিয়েছেন পরিচালক। তাদেরকে একই ফ্রেমে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে এক চমৎকার উপস্থাপন করিয়েছেন। এছাড়া ওযগারের ফটোগ্রাফার বাবা জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে ছবি তুলে রাখার যে চেষ্টা দেখানো হয়েছিল চলচ্চিত্রজুড়ে , তা মানুষের জীবনটাকে উপভোগ করার এবং জীবনের বিভিন্ন সময়গুলো ফ্রেমে বন্দী করে রাখার একটা অসাধারণ প্রয়াস বলা যেতে পারে। বিশেষ করে যখন ওযগারের জন্মের আগ মুহূর্তগুলো যখন তার বাবা ক্যামেরায় বন্ধী করে রাখছিল।
তাছাড়া দৃশ্যায়নের পাশাপাশি চলচ্চিত্রটির মিউজিকের ব্যবহার দারুণভাবে আন্দোলিত করার মতই। বাবার কিনে দেওয়া শখের ক্যামেরা বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে ওযগার ও তার বন্ধুর গিটার কেনা , সংগীতের প্রতি ভালোবাসা এবং পাশাপাশি বাবার স্মৃতি ধরে রাখা , এইসব সবকিছুর পাশাপাশি আবার ডেনিজের অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা এবং তার পরিবারের নিষেধ সবই চলচ্চিত্রের কাহিনীকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রিকতা। সেট , কস্টিউম , লোকেশন সবই গল্পের প্রয়োজনে সামাঞ্জস্যতা বজায় রেখেছে। ভালো লাগার মত বেশ কিছু লোকেশন ছিল ছবিজুড়ে। কখনও মনে হয়েছে চলচ্চিত্রটি ধীরে এগোচ্ছে আবার কখনও মনে হয়েছে দ্রুত যেন ফুরিয়ে যাচ্ছে। ভালোবাসা ,আবেগ , দায়িত্ববোধ কিংবা শ্রদ্ধাবোধের দারুণ এক মিশেল এই চলচ্চিত্র। আর পরিচালক ওমর ফারুক সরাক এ সবকাজগুলো দারুনভাবে একইসুতোয় এনেছেন এবং চমৎকার এক হৃদয়স্পর্শী ভালোবাসার ছবি উপহার দিয়েছেন।
0 comments:
Post a Comment