ঢাকা: মোবাইল ফোন কেনার সময় অনেক ক্রেতাই এর ক্যামেরা দেখে আকর্ষিত হন। মুঠোফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো সেটা বুঝতে পেরেছে বলেই এখন বাজার ধরতে উন্নত ক্যামেরাযুক্ত ফোন তৈরি করছে। কিন্তু ভালোমানের স্মার্টফোন ক্যামেরা তৈরির এ দৌড়ে একেকটি প্রতিষ্ঠান একেক রকম পদক্ষেপ নিচ্ছে। যার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, ক্রেতাদের পক্ষে বিভিন্ন ধরনের মুঠোফোনের ক্যামেরার মূল বিষয়গুলো ধরে পার্থক্য নির্ণয় করা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কোন ক্যামেরা ভালো হবে ক্রেতারা অধিকাংশ সময়ই সেটা বুঝে উঠতে পারেন না। স্যামসাংয়ের তৈরি গ্যালাক্সি এস৪ যে পিক্সেলে ছবি তোলে নকিয়ার লুমিয়া ১০২০ মডেলের ক্যামেরার চেয়ে তাতে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। তেমনি আইফোন৫এসে যে ক্যামেরা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় এইচটিসি ওয়ানের চেয়ে তা আলাদা। এসব হাইএন্ড বা বেশি দামের স্মার্টফোনে কী ধরনের ক্যামেরা ব্যবহার করা হচ্ছে বা কোন ক্যামেরা বেছে নিলে ভালো ছবি তোলা যাবে তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যান অনেক স্মার্টফোন ক্রেতা। স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্যামেরার উন্নতির ক্ষেত্রে নানা পদ্ধতি গ্রহণ করেছে।
বেশ কয়েক বছর ধরেই ক্যামেরা নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো তাঁদের পণ্যে পিক্সেল ঘনত্ব বাড়ানোর পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও ক্যামেরা নির্মাতাদের এ নীতি গ্রহণ করেছে। উদাহরণ হিসেবে ২০১০ সালে স্যামসাংয়ের বাজারে আনা ‘গ্যালাক্সি এস’ স্মার্টফোনটির কথা বলা যায়। এ স্মার্টফোনটিতে সেসময় মাত্র ৫ মেগাপিক্সেলের ক্যামেরা ছিল। কিন্তু এ বছরের জুন মাসে বাজারে আনা ‘গ্যালাক্সি এস৪’ স্মার্টফোনটিতে পিক্সেল বাড়িয়ে ১৩ মেগাপিক্সেলের ক্যামেরা যুক্ত করেছে স্যামসাং। ক্যামেরায় পিক্সেল বাড়ানোর এ পদ্ধতিটি নেহাত মন্দ নয় বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাঁদের যুক্তি হচ্ছে, অধিক পিক্সেলের অর্থ হচ্ছে এ স্মার্টফোন বিস্তারিত ছবি তুলতে পারে এবং ছবি হয় ঝকঝকে। কিন্তু উন্নত পিক্সেলের সঙ্গে উন্নতমানের ছবি পেতে গেলে ক্যামেরাকে একটি বিশেষ সফটওয়্যারের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয় যা ছবির পিক্সেলকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে উত্কৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে সনি। উন্নত লেন্সের পাশাপাশি বেশি মেগাপিক্সেলের ইমেজ সেন্সর যুক্ত করে সনি। সনির এক্সপেরিয়া জেড১ স্মার্টফোনটির সঙ্গে রয়েছে ২০.৭ মেগাপিক্সেলের ক্যামেরা ও জি লেন্স যা স্মার্টফোনের প্রচলিত লেন্সের চেয়ে অধিক উন্নত।
অবশ্য, প্রচলিত মেগাপিক্সেল পদ্ধতি কতো উন্নতভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে তার উত্কৃষ্ট উদাহরণ তৈরি করেছে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান স্যামসাং। স্যামসাং যদিও তাদের স্মার্টফোনের প্রচারের সময় ক্যামেরা নিয়ে বেশি কথা বলে তারপরও পারফরমেন্সের বিচার করলে প্রতিষ্ঠানটির বেশ কয়েকটি মডেলের স্মার্টফোন ছবি তোলার জন্য বিশেষ উপযোগী। উন্নত পিক্সেলের ঝকঝকে ছবি ও ভিডিওচিত্র ধারণের জন্য গ্যালাক্সি এস৩ ও এস৪ সমাদৃত। এ ছাড়াও গ্যালাক্সি নোট ৩ ও নোট ২ উন্নত ছবি তুলতে পারে।
কম আলোতে ছবি তোলার সময় প্রচলিত ক্যামেরা পদ্ধতির দুর্বলতা বোঝা যায়। অর্থাত্ আলো কম থাকলে ছবি ভালো ওঠে না। ছোটো ইমেজ সেন্সরে অধিক পিক্সেল কিংবা স্মার্টফোনে বড় ইমেজ সেন্সর বসানোর জায়গা না থাকায় পিক্সেলের আকার ছোট হয়ে যায়। পিক্সেল হচ্ছে ছবির ক্ষুদ্রতম একক যার অভ্যন্তরে আর কোন ভগ্নাংশ নেই;অর্থাত্ পিক্সেল ছবির অতি ক্ষুদ্র অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। ছোটো সেন্সরে স্মার্টফোন নির্মাতারা পিক্সেলের ঘনত্ব বাড়িয়ে দেওয়ার কারণে পিক্সেল আরও ক্ষুদ্রতর হচ্ছে। যার অর্থ, কম আলোয় ছবির মান খারাপ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। বর্তমানে দুটি প্রতিষ্ঠান এ সমস্যা থেকে বের হয়ে এসে বড় পিক্সেল নিয়ে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠান দুটি হচ্ছে এইচটিসি ও অ্যাপল। এইচটিসি ওয়ানের ক্ষেত্রে, তাইওয়ানের প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি এমন একটি ইমেজ সেন্সর যুক্ত করেছে যা কেবল মাত্র চার মেগাপিক্সেলে ছবি তোলে। এইচটিসির দাবি, অনলাইনে ও সামাজিক যোগাযোগের সাইটের জন্য ছবি তোলার ক্ষেত্রে এটাই অনেক বড় মাপ। এইচটিসির সেন্সরে পিক্সেলের ঘনত্ব কম থাকায় বড় পিক্সেল পদ্ধতি ব্যবহূত হয় যাতে অধিক আলো ধরে রাখা যায় এবং কম আলোতে ভালো ছবি ওঠে। বড় মাপের পিক্সেল পদ্ধতি ব্যবহারের জন্য এইচটিসির ক্যামেরাটি কম আলোতে ছবি তোলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো। তবে মাত্র ৪৩ মেগাপিক্সেলের ক্যামেরা হওয়ায় এটি ছবির বিস্তারিত অনেক কিছু ধরতে পারে না। গ্যালাক্সি এস৪ বা আইফোন৫ এর তুলনায় এইচটিসি ওয়ানের ক্যামেরাকে তাই গড় মানের ক্যামেরা বলা যায়।
অ্যাপলের সম্প্রতি বাজারে আনা আইফোন৫এসের ক্ষেত্রে এইচটিসির মতো বড় পিক্সেল পদ্ধতি ব্যবহূত হয়েছে। তবে, এক্ষেত্রে কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করেছে অ্যাপল কর্তৃপক্ষ। আইফোন৫ এর মতো আইফোন ৫এসে পিক্সেল ঘনত্ব ঠিক রেখে সেন্সরের আকার বড় করেছে। আইফোন৫এস আট মেগাপিক্সেলের ছবি তুলতে পারে তবে পিক্সেলের আকার আগের তুলনায় বড় হয়েছে। এতে করে ছবির মানের ক্ষেত্রে ভারসাম্য আসবে বলে মনে করছে অ্যাপল।
লুমিয়া ১০২০ছবি তোলার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার একটি পদ্ধতি ওভারস্যাম্পলিং। কেবল ফিনল্যান্ডের মুঠোফোন নির্মাতা নকিয়া এ পদ্ধতিটি ব্যবহার করে। নকিয়া এ পদ্ধতিটির নাম দিয়েছে ‘পিওরভিউ’। নকিয়া ৮০৮ ও লুমিয়া ১০২০ মডেলে এই ক্যামেরা প্রযুক্তিটি ব্যবহূত হয়েছে। এই প্রযুক্তিটির বিশেষত্ব হচ্ছে নকিয়ার তৈরি ৪১ মেগাপিক্সেলের ইমেজ সেন্সর।
নকিয়ার লুমিয়া ১০২০ মডেলের স্মার্টফোনটির তোলা ছবিতে কেবল ৫ মেগাপিক্সেল পাওয়া যায় বলে অনেকে ধারণা করেন। ৪১ মেগাপিক্সেলের ক্যামেরায় মাত্র ৫ মেগাপিক্সেল! নকিয়া কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আদতে পাঁচ মেগাপিক্সেলের ছবি দেখতে পেলেও পুরো ৪১ মেগাপিক্সেলের সেন্সরের সাহায্য নিয়ে তোলা ছবিকে ৫ মেগাপিক্সেলে রূপান্তর করে দেখানো হয়। ৪১ মেগাপিক্সেলের তোলা ছবিকে ৫ মেগাপিক্সেলে দেখানোর ফলে সুপার পিক্সেল তৈরি হয় যা ছবির বিস্তারিত দেখাতে পারে। নকিয়া এই প্রক্রিয়াটিতে ওভারস্যাম্পলিং বলে।
যেকোনো পরিবেশে নকিয়ার এ ক্যামেরা প্রযুক্তি উন্নত ছবি তুলতে পারে। এ ক্যামেরা ব্যবহারকারীদের অভিমত হচ্ছে, পিওরভিউ প্রযুক্তির ক্যামেরার কথা শুনতে যতো ভালো লাগে ছবি তুলতে তার চেয়েও বেশি মজার।
ক্লিয়ারপিক্সেল পদ্ধতিটি অনুসরণ করছে গুগলের অধীনস্থ মটোরোলা। সাধারণত ক্যামেরায় তিনটি রং লাল, নীল সবুজ (আরজিবি) সেন্সর ডিজাইন পদ্ধতি ব্যবহূত হয়। এ পদ্ধতিটির নাম বেয়ার ফিল্টার পদ্ধতি। সহজ কথায় বলতে গেলে, ক্লিয়ারপিক্সেল ক্যামেরায় লাল, নীল সবুজ এ তিনটি পিক্সেল ধারণ করা হয়। পরে এ পিক্সেল প্রক্রিয়াজাত করে সর্বশেষ ছবি হাজির হয়। মটোরোলার ‘মটো এক্স’ স্মার্টফোনটিতে অবশ্য চারটি রং ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে। আরজিবিসি অর্থাত্ রেড, গ্রিন, ব্লু ও ক্লিয়ার এ চারটি পিক্সেলের সহায়তার পরিষ্কার ও ঝকঝকে ছবি তুলতে পারে মটো এক্স। এ ছাড়াও কম আলোতে ভালো ছবি তুলতে পারে। বাস্তবে মটো এক্স গ্যালাক্সি এস৪ বা লুমিয়া ১০২০এর মতো পারফরমেন্স দেখাতে পারেনি। সফটওয়্যার আপডেট এনে মটোএক্সের ক্যামেরার পারফরমেন্স উন্নত করছে মটোরোলা।
আলাদা আলাদা ইমেজ সেন্সর প্রযুক্তি নিয়ে স্মার্টফোন নির্মাতারা কাজ করলেও ক্যামেরায় লেন্সের নকশার ক্ষেত্রে উন্নতি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নকিয়া তাদের লুমিয়া ৯২০ মডেলের স্মার্টফোনে অপটিক্যাল ইমেজ স্ট্যাবিলাইজেশনের প্রচলন করেছিল। এখন এইচটিসি ওয়ান, লুমিয়া ৯২৫, লুমিয়া ১০২০ ও এলজি জি২ স্মার্টফোনেও এ প্রযুক্তি ব্যবহূত হচ্ছে।
অপটিক্যাল ইমেজ স্ট্যাবিলাইজেশনের কারণে ছবি ও ভিডিও ঝকঝকে হয়। একইরকমভাবে ক্যামেরা লেন্সের ক্ষেত্রে এইচটিসি ওয়ান ও এক্সপেরিয়া জেড ওয়ানে এফ২.০ অ্যাপারচার রয়েছে। আইফোন ৫এসে অ্যাপারচার এফ২.২। অ্যাপারচারকে মানুষের চোখের মনির সঙ্গে তুলনা করা হয়। চোখের মনিতে আলো পড়লে তা যেমন আপনাআপনিই ছোট হয়ে যায় আবার কম আলোতে বড় হয়ে যায়, অ্যাপারচার বিষয়টিও কিছুটা এমন ধরনেরই। ইংরেজি এফ অক্ষর দিয়ে অ্যাপারচার প্রকাশ করা হয়। অ্যাপারচার ভ্যালু বা এফ ডট স্টপ যত বাড়বে ক্যামেরায় আলো তত কম প্রবেশ করবে আর অ্যাপারচার ভ্যালু যত কমবে ক্যামেরায় আলো তত বেশি প্রবেশ করবে।
গবেষকেরা বলেন, তাত্ত্বিকভাবে বিবেচনায় নিলে ক্যামেরা পদ্ধতি হিসেবে সবগুলোই ভালো। কিন্তু বিবেচনার বিষয় হচ্ছে, এ ক্যামেরা পদ্ধতি স্মার্টফোনে কতোটা ভালোভাবে যুক্ত করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত স্মার্টফোনের বাজারে এককভাবে কাউকেই জয়ী বলা সম্ভব নয়। তবুও ক্যামেরা প্রযুক্তির কথা বিবেচনা করলে পিওরভিউ প্রযুক্তিটিকে এগিয়ে রাখা যায় তবে, উন্নত ছবি ও ভিডিওর কথা মাথায় রাখলে আইফোন৫এস, গ্যালাক্সি এস৪, এক্সপেরিয়া জেড১ নকিয়ার লুমিয়া ১০২০ স্মার্টফোনটির চেয়ে খুব বেশি পিছিয়ে রয়েছে সে কথাও বলা যায় না।
0 comments:
Post a Comment