তোড়া, আমি কাঁদছি। আমার জীবনটা একটা মিথ্যে স্বপ্নের মতো। বলা যায়, আমি মিথ্যে মানুষ। কখনো আমি কাদিনি। কাদতে চাইনি। আজ যখন তোড়া তুমি বললে, তুমি সুখে নেই। তখন আমার মনে হল, আমার মিথ্যে জীবনটার ইতি টানাটা খুব জরুরী ছিল। তুমি সাত সমুদ্র পার হয়ে নিউইয়র্কের রাস্তার পাশের বেঞ্চিতে বসে একা বসে আছো। এটা ভাবতেই আমার কান্না পেলো। ভালোবাসা তো তুমিই শিখিয়েছিলে। সেটা তোমার সঙ্গে আমি সাত সমুদ্র পারেই পাঠিয়েছিলাম। আজ মনে হচ্ছে, ভুল করে হলেও আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চেয়েছিলাম। সত্যি তোড়া, আমার চোখ থেকে ঝর ঝর করে পানি বইছে। আমি এক হাত দিয়ে চোখ মুছছি। আমার চোখ থেকে বড় মূল্যবান এই অশ্র“ তোমাকে কতদূর পাঠিয়ে দিলো। সবকিছু মিথ্যেয় ভরা যার জীবন, ভালোবাসার কথা বলে যে বারবার নিজেকে এবং তোমাদের সবাইকে ধোকা দিয়ে গেছে, আজ যে ভালোবাসার জন্যে কাদছে। স্বপ্ন দেখিয়েছিলে তুমি আর আমি বেছে নিলাম দুঃস্বপ্ন। শারমিন, মিতু, জলি, সীমা অনেককেই ভালোবাসতে চেয়েছিলাম। তারা ভালোবাসেনি। কারো কারো ক্ষেত্রে মিথ্যেকে সত্য ভেবে ঘোরের মধ্যে ছিলাম। মিথ্যে দিয়ে গড়েছিলাম কতরকম গল্প। তুমি ভালোবাসলে এবং চলে গেলে। আমিও ভালোবাসলাম পাগলের মত। অবশেষে সেটাও হল মিথ্যে। যখন তুমি চলে গেলে, তখন খুব দোষ দিতাম তোমায়। ভাবতাম একটা মিথ্যে মানুষকে নিয়ে জীবন গড়ার ভয় পেয়েছিলে তুমি। আজ মনে হয়, তুমি ঠিক করেছিলে। আমার মিথ্যে ঘরে তুমি এলে তুমিও যে মিথ্যে হয়ে যেতে। তোমার ভালোবাসাও যে মিথ্যে হয়ে যেত। সবকিছু ভালোই ছিল, আমার স্বপ্নহীন জীবন নিয়ে কোন খেদও আমার ছিলো না। তবে আজ কেন আমি তোমার ওই এসএমএস পেলাম। সত্যি তোড়া আমি কাঁদছি। এবং শোনো আমি আসছি।
২.
নিউইয়র্কের ফ্লাইটের টিকিট কাটতে ৯৬ হাজার টাকা লাগবে। গত কয়েকদিন ধরে বোনের বাসায় আছি। খাওয়া পরা ফ্রি। একশো দু’শো চাইলেও দেয়। কিন্তু এত টাকা কি দেবে। বললে খেপে যাবে। কেন যাবে এবং কিজন্যে যাবে হাজার প্রশ্ন। কিডনি বিক্রি করার একটা বিজ্ঞাপন দিলে কেমন হয়। তাতেও হাজার খানেক টাকার ধাক্কা। পকেটে আছে ৩৩ টাকা। এক প্যাকেট বেনসন কেনাও দরকার। একটা উপায় অবশ্য আছে। বড়ো ভাই’র বাকীর খাতায় তুলে দেয়া যায়। পাসপোর্টটা বোধহয় হারিয়ে গেছে। নতুন পাসপোর্ট করতে হবে। সব মিলে লাখ দেড়েক টাকার ধাক্কা। শালা, তোড়ার বাচ্চা। এই বুড়ো বয়সে আমাকে কি ঝামেলায় ফেললি। বায়েজিদকে ফোন করি। প্রথমবার ফোন ধরলো না। একটা এসএমএস পাঠালে কেমন হয়। ফোন ধর নয়তো রিনাকে শিলার কথা বলে দেবো। ব্ল্যাকমেইল করতে হল না। ফোন ব্যাক করেছে।
বায়েজিদের কাট কাট গলা, কি চাস।
আমিও ভনিতা ছাড়া বলি, এক প্যাকেট বেনসন।
-আসল কথা বল।
-আমার টাকা দরকার।
-কত?
বাড়িয়ে বলি, তিন লাখ।
-আমি কি তোর বাপের মত বোকা যে টাকা দেবো। আর টাকা কি ছেলের হাতের মোয়া। মদ খেতে চাস তো রাত্রে ঢাকা কèাবে আয়। এক কার্টন বেনসন দেবো। জুতা পরে আসিস। ফোনটা কেটে দিলো।
ঢাকা ক্লাবে ঢুকতে গিয়ে ঠিকই হুজ্জতি হল। সু পড়ে আসিনি। দশ বছরের পুরনো ব্লেজার পরনে ছিলো। বায়েজিদই সমাধান বের করলো। একটা বেয়ারাকে ডেকে দু’শ টাকা ধরিয়ে বললো, জুতো নিয়ে আসতে। বেয়ারা যেটা নিয়ে এলো, সেটা জুতো নয়, স্যান্ডেল সু। তাও আবার কয়েক সাইজ বড়ো। সেটাই পায়ে গলিয়ে ঢুকলাম। ফ্রি মদ বলে কথা। তাছাড়া ভিসা পেতে ওর ডেভলপার কোম্পানীর সার্টিফিকেট ম্যানেজ করতে হবে।
আমি বায়েজিদকে বলি, আমি নিউইয়র্ক যাচ্ছি।
- কেন?
- তোড়া ভালো নেই।
- তাতে তোর কি? তোড়া কি তোর জন্যে বাংলাদেশে থেকেছিল। ঠিকইতো এনআরবি’র হাত ধরে চলে গেছে। আমি হাসি। পৃথিবীর নিয়মকানুন তো আমি শিখতে পারিনি। বয়সতো কম হল না। এখন বায়েজিদ আমাকে কি শেখাবে। বলি, তুই আমাকে লাখ খানেক টাকা দে। ঘুরে আসি।
হাসে সে। বলে, তুই মানুষ হবি কবে?
হুইস্কি ঢালে। বলে, মদ খেতে এসেছিস। খেয়ে ভাগ।
আমি সিগারেট ধরাই। বলি, তোড়া এসএমএস পাঠিয়েছে।
-কি লিখেছে?
- নিউইয়র্কের রাস্তায় একা মাইনাস ফাইভে বসে আছে।
- আর কিছু!
- না।
- তাতে যেতে হবে কেন?
আমি কিভাবে বুঝাই, এর অর্থ কি। তোড়া আর কিছুই লিখবে না। ও জানে, আমি ঠিক এর অর্থ বুঝে নেবো। জানি, গেলে বলবে- মজা করেছি। তোমাকে আসতে কে বলেছে। হাসবে। দেখে খুশী হবে তবু মুখ ফুটে বলবে না।
বায়েজিদ সংবিৎ ফেরায়। বলে, কি শালা। মদ খা। তোর জন্যে সারারাত কি বারে বসবো নাকি। আমি নির্জলা হুইস্কি ঢালি গলায়। তোড়ার জন্যে মদ খাওয়া ছেড়েছিলাম। আবার ওর জন্যে ধরেছি। ওই রাতটার কথা মনে পড়ে। যে রাতে আমার ভেতরের পুরুষটা পাগল হয়ে গিয়েছিল। মদ খেয়ে কিঞ্চিৎ মাতালও ছিলাম। ঘটনাটা ঠিক মনে কোন কারণে তোড়া শ্বশুরবাড়ি থেকে রাগ করে এসেছিল। আমার ঘরে ও আগেও এসেছিল। তবে এ রুপ ওর আগে দেখিনি। সাদা জর্জেটের শাড়ী। ভেতরের জামা টামা সবই সাদা। আমার কল্পনার জোছনার পরী। রেগে আছে বুঝতে পারছি। আমার এই ছন্নছাড়া ঘরটায় হঠাৎ করে এক জোছনার পরী নেমে আসায় কেমন যেন পালটে গেছে সব। আমি কি বলবো বুঝতে পাছিলাম না। তবু বললাম, কি হয়েছে।
- কিছু হয়নি।
- রাতে থাকবে নাকি।
- কেন ভয় পাচ্ছো। তারপর আদুরে সুরে বললো, আমাকে নিয়ে পালাতে চাইতে না। আমি পালিয়ে এসেছি।
আমি হাসি। বলি, ফাজলামি করো না। আমি তোমার জন্যে কি করতে পারি, তুমি তা ভালোই জানো।
পরী হাসে। বলে, ছেলেরা শুধু মুখেই পারে। যদি বলি, এ মূহুর্তে আমাকে নিয়ে এমন কোথাও পালিয়ে যাও। যেখানে কেউ খুজে পাবে না।
আমি জায়গা খুজতে পারি। গ্রামের বাড়ি যেতে পারি। কক্সবাজারে রাশেদের বাংলো বাড়িতে চলে যেতে পারি। রাজা ভাইয়ের বাসায় যেতে পারি। চন্দনা ভাবী বিরক্ত হবে না। বলবে, তবু তো তোর একটা হিল্লে হোল। তারপর তোড়াকে বলবে, তুমি কি ভুল করলে এখন বুঝবে না। পরে বুঝবে। তোড়াই আমার সংবিৎ ফেরায়। বলে, ঘাবড়িও না। আমি একা একা বসে কাদতে এসেছি। বলে, ওখানে বসে কাদতে পারি না। খুব কান্না পেল। বাসায় গিয়েও লাভ নেই। ওটা এখন তো আর মা’র বাসা নেই। ভাইয়ের বাসা হয়ে গেছে।
আমার খাটের ওপর বসে তোড়া কাদছে। নিঃশব্দ কান্না। আমার জোছনার পরী কাদছে। ভরা পূর্ণিমায় জোছনা যেভাবে গলে গলে পড়ে। আমার ছোট ফ্ল্যাটের রং চটা ছাদ, দেয়াল, সব কিছু গলে গলে পড়ছে। আমি সহ্য করতে পারি না। আমি শুধু বলি, কি হয়েছে বল। তোড়া চিৎকার করে বলে, তুই আমাকে একা থাকতে দে। বাসা থেকে বেরিয়ে যা। আমি ওর অগ্নিমুর্তির সামনে দাড়াতে পারিনি। ছিটকে বেরিয়ে এসেছিলাম বাসা থেকে। সেই তোড়া আবার কাদছে। নিউইয়র্কের রাস্তায় শীতের মধ্যে জমে জমে। ভাবতেই আমার চারপাশটা কেমন যেন হাহাকার করে উঠলো। আমি নির্জলা হুইস্কি ঢালি গলায়। বলি, বায়েজিদ, আমি নিউইয়র্ক যাবোই। কিডনি বেচে হলেও যাবো।
ও হাসে, বলে- তোর কিডনি কে কিনবে। মদ খেয়ে খেয়ে ওটায় কি কিছু আছে।
হায়রে মদ, এই মিথ্যে মানুষটার জীবনে একমাত্র সত্যি তো তুমিই।
বায়েজিদ বলে, এসব পাগলামি ছাড়। তোর জন্যে একটা চাকরি জোগাড় করেছি। করবি।
আমি গলায় মদ ঢালতে ঢালতে বলি, না। না-টা বেশ জোরেই বলেছি, বারের সবাই ঘাড় উচু করে আমাকে দেখে। বায়েজিদ হাসে, বলে- তোর এই মিথ্যে জীবন কবে শেষ হবে রে!
0 comments:
Post a Comment