রুপকথার আকাশে আজ বিশাল একটা চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে চারদিক। প্রবল জোৎস্নায় নদীতে বান ডেকেছে। জোয়ার এসেছে মানুষের মনেও। বিস্তৃত চারণভূমির পাশে একটা বেশ পুরনো বটগাছ। বটগাছের কালচে সবুজ পাতায় এসে চাঁদের আলো পড়ছে। চাঁদের আলোয় সবুজ পাতাগুলি রুপার মত চক-চক করছে।
সেই বটগাছের নিচে একজন আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।
অনেকদিন আগে, এক পূর্ণিমার রাতে এই পৃথিবীতে একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল। সাত সাগর-তের নদীর ওপাড় থেকে পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়ে রুপনগরের রাজকন্যা চলে এসেছিল এই জন-মানবহীন প্রান্তরে। বটগাছের চক-চকে পাতার রুপে মুগ্ধ হয়ে রাজকন্যা যখন বটগাছের নিচে এসে দাড়াল তখনি তার সাথে দেখা হয়ে গেল এক রাখাল বালকের। রাখাল বালক বাঁশী বাজাচ্ছিল। বাঁশীর সুর রাজকন্যার মুগ্ধতা বাড়িয়ে দিল হাজার গুন। এদিকে রাজকন্যাকে দেখে রাখাল বালকের বাঁশী থেমে গেল। যত সুর ছিল সব ভুলে গেল। রাজকন্যার রুপে সে কিছুক্ষনের জন্য বিভ্রান্ত হয়ে গেল। এটা বেহেস্তের হুর নাতো!
"বাঁশীর সুর থামিয়ে দিলে কেন? বাজাও না।"
রাখাল বালক চমকে উঠল। যেমন রাজকন্যার রুপ। তেমন তাঁর কণ্ঠ! মনে হচ্ছে তাঁর গলা দিয়ে শুধু স্বরই বের হচ্ছেনা। সাগরের ঢেউয়ের গর্জন,পাখির কূজন আর বৃষ্টির রিম-ঝিম শব্দ মিলে-মিশে একাকার হয়ে বের হচ্ছে। রাজকন্যার বলা প্রতিটি বাক্য যেন এক-একটা মহান সংগীত!
"কি হল, বাজাওনা কেন?" রাজকন্যার কোমল মিষ্টি কণ্ঠ আবার ভেসে আসে। রাখাল বালক কাতর স্বরে বলে
"রাজকন্যা আমি সত্যি বলছি, তোমাকে দেখার পর আমি সব সুর ভুলে গেছি।"
"চেষ্টা করে দেখ।"
রাখাল বালক চেষ্টা করে। পাগলের মত স্মৃতি হাতরায়। কোন সুরই খুঁজে পায়না সে। রাজকন্যা অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করে। তারপর, দু-জন কিছুক্ষন পাশা-পাশি দাড়িয়ে থাকে। রাত শেষ হওয়ার আগে-আগে রাজকন্যা তাঁর পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চেপে বসে। বিদায় বেলায় রাখাল বালকের চুল আলতো করে ছুয়ে দিয়ে বলে "শুনো, আমি আবার আসব। ঠিক এমন এক পূর্ণিমার রাতে। সারারাত তোমার বাঁশীর সুর শুনে মুগ্ধ হব। সকাল হলে তোমাকে সাথে করে আমাদের দেশে চলে যাব। তোমাকে বানাব রুপনগরের রাজপুত্র!"
রাজকন্যার পঙ্খিরাজ ঘোড়া পাখা মেলে আকাশে উড়াল দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে রাখাল বালকের মাথায় একটা সুর আসল। আশ্চর্য রকম সুন্দর মায়াময় একটা সুর। অথচ অপরিচিত। এর আগে মনে হয়না পৃথিবীর কারো বাঁশীতে এমন সুর বেজেছে। রাখাল চিৎকার করে রাজকন্যাকে ডাকল। রাজকন্যা তাঁর ডাক শুনতে পেলনা। রাজকন্যার পঙ্খিরাজ ঘোড়া ততক্ষনে মেঘের আড়ালে চলে গেছে।
আহা! রাজকন্যা যদি সেদিন রাখালের ডাক শুনত।
বহুদিন পর। বৃদ্ধ রাখাল সেই পুরনো বটগাছের নিচে বসে আছে। ধব-ধবে সাদা একটা চাদরে তার শরির ঢাকা। চাদরের আড়ালে একটা বাঁশি লুকানো আছে। তাঁর বিশ্বাস কোন একদিন অবশ্যই রাজকন্যা আসবে তাঁর বাঁশীর সুর শুনতে। সে আশায় বৃদ্ধ রাখাল প্রতিক্ষার প্রহর গুনে।
এখন মাঝরাত। চাঁদের আলো তীব্র হতে শুরু করেছে। বৃদ্ধ রাখাল আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। নষ্ট চোখে চাঁদটাকে খুব ঘোলাটে লাগছে। বৃদ্ধ কাঁপা-কাঁপা হাতে একটা বটপাতা তুলে নিয়ে চোখের সামনে ধরল। পাতার আড়ালে চাঁদটা ঢাকা পড়ে গেল। বৃদ্ধ রাখাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাদরের আঁচলে চোখ মুছল। দুরত্বের পরিমাপ ঠিক থাকলে বিশাল চাঁদকে ঢাকার জন্য একটা ছোট্ট পাতাই যথেষ্ট।
0 comments:
Post a Comment