বিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালার এক অপূর্ব বন্ধন। সমাজের প্রতিটি মানুষ বয়:সন্ধিক্ষণে এই অপূর্ব ও পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই বন্ধনের মাধ্যমে একজন পুরুষ ও নারীর মধ্যে অবিচ্ছেদ্য এক সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। এই সম্পর্কের মাধ্যমে নারী ও পুরুষের ঔরসজাত হয়ে পৃথিবীর মুখ দেখে নতুন প্রজন্ম। আপাতদৃষ্টিতে বিয়ে দুটি মানুষের মধ্যে হলেও এর সাথে জড়িয়ে থাকে তাদের পরিবার ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। তাদের হাত ধরেই গড়ে ওঠে নতুন একটি পরিবার, নতুন একটি প্রজন্ম।
বিয়ের মূল উদ্দেশ্য উপরোক্ত কথা হলেও বিয়েকে এখন ব্যবহার করা হচ্ছে বাণিজ্যিক হিসেবে। অভিনব কায়দায় বিভিন্ন মিডিয়াতে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করে বিশ্বের উন্নত দেশে পাড়ি দেয় অর্থ উপার্জনে। আবার বিয়ে শব্দটির অপব্যবহার করে কতিপয় দুর্বৃত্তরা হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এ প্রতারকরা বিভিন্ন পত্রিকায় আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে লোকজনকে আকৃষ্ট করে। বিজ্ঞাপন দেখে তাদের সখে যোগাযোগ করলেই আর রক্ষা নেই। যেভাবেই হোক ফোন দেয়া ব্যক্তিটির কাছ থেকে টাকা হাতাবেই।
এসব প্রতারক চক্রের কবলে পড়া বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন ওয়ালিউর রহমান (ছদ্মনাম)। কিছুদিন আগে একটি দৈনিক পত্রিকায় কানাডা প্রবাসী সিটিজেন পাত্রীর জন্য পাত্র চাই শিরোনামে একটি বিজ্ঞাপন দেখে ফোন দেন। অপরপ্রান্ত থেকে এক ভদ্রলোক তাকে দেখা করার আমন্ত্রণ জানান। তিনি পরদিন তাদের দেয়া ঠিকানায় যান।
সাক্ষাতের এক পর্যায়ে তারা ওয়ালিউরকে জানায়, কানাডা যেতে হলে ৫ লাখ টাকা দিতে হবে। অথচ ওই বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল পাত্র পছন্দ হলে কোন টাকা লাগবে না। ওয়ালিউর বিজ্ঞাপনের কথা মনে করিয়ে দিলে প্রতারকরা তাকে জানায়, এটা পাত্রীর জন্য নয়, আমাদের খরচ।
কিছুদিন পর ওয়ালিউর তার অনেক কষ্টে জমানো ১ লাখ টাকা তুলে দেন প্রতারকদের হাতে। চুক্তি অনুযায়ী পাসপোর্টও জমা দেন। বাকী টাকা পাত্রীর সঙ্গে কথা বলে পরিশোধ করবেন বলে প্রতারকদের জানিয়ে দেন। কিন্তু বাকী টাকা না নিয়েই চম্পট মারে প্রতারকরা। টাকা লেনদেনের পর ওয়ালিউর প্রতারকদের ওই অফিস নিয়মিত তালাবন্ধ দেখতে পান। এমনকি তাদের মুঠোফোন নম্বরগুলোও বন্ধ ছিল।
ওয়ালিউরের মতো আজিজুল ইসলাম নামের অপর এক যুবকও আমেরিকা যাওয়ার জন্য প্রতারকদের একটি চক্রকে ৩ লাখ টাকা দিয়েছেন। তাদের মতো এরকম অসংখ্য সরলমনা যুবক প্রতিনিয়ত জড়িয়ে যাচ্ছেন গজে উঠা ভুয়া ম্যারেজ মিডিয়ার প্রতারণার ফাঁদে। রাজধানীজুড়ে প্রতারণার এরকম অভিনব ফাঁদ পেতে রেখেছে সংঘবদ্ধ একটি প্রতারক চক্র।
অনুসন্ধানে এমন ঘটনাও জানা গেছে, টাকা নেয়ার পর পাত্র-পাত্রীর বিয়ে হয়েছে। কিন্তু হতভাগা পাত্র তার বিয়ে করা পাত্রীর সঙ্গে বাসর ঘরে যেতে পারে না। প্রতারকরা বিভিন্ন ছলাবলা দেখিয়ে বাসর করা থেকে পাত্রকে বিরত রাখে। আবার এর ব্যতিক্রম ঘটছে। বিয়ে হয়েছে, বাসরও হয়েছে। কিন্তু প্রতারকদের সহযোগিতায় পাত্রী দু’চারদিন কিংবা সপ্তাহ খানেক পর পাত্রের বাসা থেকে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র নিয়ে সুযোগ বুঝে পালিয়ে যায়। বিয়ের সময় সুন্দরী পাত্রীরা নকল বাবা-মা সাজিয়ে এরকম করে আসছে। প্রতারকদের পাতানো ফাঁদে প্রতিদিনই কেউ না কেউ ধরা দিচ্ছেন। এরকম ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েকটি বিভাগীয় শহরে। ভুয়া প্রবাসী পাত্রীকে বিয়ে করার নামে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন নিরীহ যুবকরা।
বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও ইউরোপ প্রবাসী সুন্দরী তরুণীদের কনে সাজিয়ে সাধারণ যুবকদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সংঘবদ্ধ চক্র। ভুক্তভোগীদের অভিযোগের পর গত শুক্র ও শনিবার রাজধানীর শ্যামলী ও আফতাব নগরে অভিযান চালিয়ে এমন একটি চক্রের মূল হোতা এরশাদ ও তিন তরুণীসহ ৮ জনকে গ্রেফতার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন জাল বিদেশি পাসপোর্ট, ভিসা, বিয়ের কাবিননামা ও নোটারি পাবলিকের রাবার স্ট্যাম্প উদ্ধার করা হয়।
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে প্রতারকরা জানিয়েছে, তারা ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভুয়া নাগরিক সেজে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে দীর্ঘদিন প্রতারণা করে আসছে। সুন্দরী তরুণীদের কখনো কানাডা, কখনো আমেরিকা আবার কখনো লন্ডনের সিটিজেন কন্যা সাজিয়ে তারা বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। এভাবে প্রতারণা করে তারা লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তাদের সংঘবদ্ধ চক্রে কিছু সুন্দরী তরুণী রয়েছে। তাদের নামে জাল ভিসা ও পাসপোর্টও তৈরি করা হয়। পরে তা তাদের ফাঁদে পা দেয়া যুবককে দেখিয়ে বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা করে। নোটারির মাধ্যমে অনেক সময় প্রতারক চক্রের তরুণীদের নামও পরিবর্তন করানো হয়।
ডিএমপির মিডিয়া শাখার উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান বলেন, ম্যারেজ মিডিয়ার নামে সুন্দরী তরুণীদের বিদেশি নাগরিক পরিচয়ে একটি চক্র প্রতারণা করে আসছিল। চক্রটি বিভিন্ন পত্রিকায় ‘সুন্দরী বিদেশি কন্যার জন্য যোগ্য পাত্রী চাই’ শিরোনামে প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন দিয়ে সাধারণের সঙ্গে প্রতারণা করছিল। তারা বিয়েতে আগ্রহী যুবককে তরুণীর জাল ভিসা ও পাসপোর্ট দেখিয়ে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে। এক পর্যায়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। পরে অফিস পরিবর্তন করে আবারও একই ব্যবসায় নামে চক্রটি। এভাবেই তাদের প্রতারণার ফাঁদে সর্বস্ব হারাচ্ছে এক শ্রেণীর সরলমনা যুবক।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, এক শ্রেণীর ভুয়া ম্যারেজ মিডিয়া প্রতিষ্ঠান বিত্তশালী পাত্রী ও বিয়ে করে বিদেশে ইমিগ্রান্ট হওয়ার কথা বলে অসহায় পাত্রের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। খোদ রাজধানীতে এধরণের একাধিক প্রতারকচক্র সক্রিয় রয়েছে। বিয়ের পর বর-কনেকে স্বপ্নের দেশ ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় পাঠানো হবে বলে প্রতিদিনই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে। নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে রাজধানীতে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে এধরনের অসংখ্য ম্যারেজ মিডিয়া। নামে-বেনামে গড়ে উঠা এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগেরই বৈধ অনুমোদন নেই। মাঝে মধ্যে প্রতারণা করার অভিযোগে এর সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করা হলেও পরে তারা জামিনে বের হয়ে একই ব্যবসায় ফিরে আসে। গ্রেফতার, জেল-জরিমানার খড়গ থাকলেও ম্যারেজ মিডিয়ার নামে প্রতারণার বন্ধ হচ্ছে না। এদের প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
0 comments:
Post a Comment