সৌখিন আলোকচিত্র শিল্পীরা বন্ধ হয়ে যাওয়া হাসপাতাল, পরিত্যক্ত সামরিক ভূখণ্ড এবং কলকারখানায় তথাকথিত ‘হারিয়ে যাওয়া অঞ্চল’এ তাঁদের ছবির মোটিফ খুঁজে বেড়ান৷ তবে তা আইনসম্মত হতে হবে এবং একমাত্র গাইডসহ টুরের মাধ্যমেই তা সম্ভব৷
‘স্টপ! প্রবেশ নিষেধ! নতুবা বিপাক'৷ শহর এলাকা এবার্সভাল্ড এ বেড়া দেয়া একটি প্রায় ধসে পড়া পরিত্যক্ত কারখানার বাইরে ঝুলছে একটি কাঠের সাইনবোর্ড৷ মোটা অক্ষরে এই লেখার পাশেই শোভা পাচ্ছে সযত্নে আঁকা কালো একটি বোমা এবং একজোড়া অন্ধকারাচ্ছন্ন চোখ৷ ভিতর থেকে ভেসে আসছে মৃদু ‘ক্লিক', ‘ক্লিক' শব্দ৷ না, কোনো অস্ত্র নয়, ক্যামেরায় ছবি তোলার শব্দ৷ সৌখিন আলোকচিত্র শিল্পীরা পরিত্যক্ত ভবনে তাঁদের ছবির মোটিফ খুঁজে বেড়ান
টুর গাইড থিলো ভিবারসের নেতৃত্বে অপেশাদার আলোকচিত্র শিল্পীর একটি দল এই জরাজীর্ণ কারখানার বিভিন্ন দিক শৈল্পিকভাবে নথিভুক্ত করছেন তাঁদের ক্যামেরায়৷ কিন্তু এতে বিপদের ঝুঁকি রয়েছে প্রচুর, রয়েছে নিরাপত্তার অভাব, এমনকি এমন নির্জন অঞ্চলে ছবি তোলার সময় আক্রমণেরও শিকার হয়েছেন কেউ কেউ৷
বার্লিনের একটি প্রতিষ্ঠান ‘গো টু নো' এ ধরনের নিরাপদ দলগত টুরের ব্যবস্থা করে নির্ধারিত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে৷ সরকারি অনুমোদনপত্রও থাকে সেই সাথে৷ এই প্রতিষ্ঠানের টুর গাইড ভিবারস, সাতজন মহিলা ও ১৩ জন পুরুষের একটি দলকে নিয়ে এসেছেন ১০০ বছরের পুরোনো একটি পেপার মিলে৷ ১৯৯৪ সালে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায় এই মিল৷ তারপর থেকেই এখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ৷ এই দলে রয়েছেন জার্মানির বিভিন্ন শহর থেকে আগত সৌখিন ফটোগ্রাফাররা৷ সেই সাথে আরো কয়েকজন এসেছেন নেদারল্যান্ডস ও গ্রিস থেকে৷ ক্যামেরা, ট্রাইপড আর টর্চলাইটে সজ্জিত তাঁরা৷
এই ভবনের সেলার থেকেই শুরু হয় তাঁদের পরিদর্শন৷ স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার পরিবেশ৷ নীচ থেকে ভেসে আসছে একটি ছোট্ট নদীর স্রোতধ্বনি৷ এই স্রোতই এককালে ঘুরিয়েছে বড় বড় মিল৷ উপরে বিরাট হল রুমের প্রায়ই পুরোটাই ভেঙে পড়েছে৷ জানালার ভাঙা কাঁচ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এখান সেখানে৷উপরে ভাঙা ছাদ৷ তার ভিতর দিয়ে পানি ঢুকে মেঝেতে সৃষ্টি হয়েছে শেওলাযুক্ত একটি ছোট্ট হ্রদ৷ এই হ্রদের কিছুটা উপরে ছাদ থেকে ঝুলে রয়েছে একটি লম্বা কাঠ৷ তাতে এখনো যুক্ত আছে একটি অক্ষত বাল্ব৷ এতদিনেও বাল্বটি ভেঙে যায়নি৷ দেখলে মনে হয় ‘সুইচ' টিপলেই বুঝি আলো জ্বলে উঠবে৷ ক্লিক, ক্লিক৷ এ দৃশ্য ছবির একটা দারুণ মোটিফ তো বটেই! চারদিক ঘুরে দেখলে বোঝা যায় যে এখানে অনুমোদন ছাড়া অনেকেরই পদধূলি পড়েছে৷ বিশেষ করে বিগত কয়েক বছরে ছাপ রেখে গেছেন বহু শিল্পী৷ দেয়ালে গ্র্যাফিটি৷ তাতে বিভিন্ন নামের সারি, দেয়াল-চিত্র আর রুম ইনস্টলেশনের অংশবিশেষ দেখা যাচ্ছে৷
সৌখিন ফটোগ্রাফাররা বিগত কয়েক বছর যাবৎ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এরকম পরিত্যক্ত বা সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ এলাকায় গিয়ে নান্দনিকভাবে ‘মোরবিড মোটিফ' আবিষ্কারের চেষ্টা করছেন৷ এ ধরণের আলোকচিত্র শিল্পকে বলা হয় ‘আর্বান এক্সপ্লোরিং'৷ তাদের সূবর্ণ মটো: ‘ছবি তোলো, পেছনে রেখে যাও শুধু পদচিহ্ন'৷ এ সমস্ত ‘হারিয়ে যাওয়া অঞ্চল'-এর ছবি তাঁরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে একে অপরের সাথে আদান-প্রদান করেন৷ এমনকি নিজেদের মধ্যে ছবির প্রতিযোগিতাও হয়৷
তবে এই সব পরিত্যক্ত এলাকার আশেপাশের প্রতিবেশীরা এই ‘নিষিদ্ধ' এলাকায় আগন্তুকের আনাগোনা খুব একটা ভালো চোখে দেখেন না৷ তাছাড়া মালিকের অনুমতি ছাড়া প্রবেশ মানেই যে অনধিকার প্রবেশ! এই পেপার মিলের প্রতিবেশীরাও তাই এ ব্যাপারে সজাগ৷ প্রতিবাদ জানালে টুর গাইড থিলো ভিবারস তাঁদের জানান, এই দলের প্রবেশের অনুমতি-পত্র রয়েছে৷ তারপর আর কী? একথা শুনে শান্ত মনেই ফিরে যান প্রতিবেশীরা৷ আর চলতে থাকে ছবি তোলা – ক্লিক, ক্লিক৷
0 comments:
Post a Comment