চুড়িবন্দনা: শরতচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায় তার ‘অরক্ষণীয়া’ উপন্যাসে নারীর চুড়িপ্রেম ফুটিয়ে তুলেছেন
বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্যে। বুড়ো মেসতুতো ভাই জ্ঞানদার হবু বউয়ের জন্য মাসিমা
দুর্গামণির হাতে অতুল যেই আকর্ষণীয় চুড়ি তুলে দিয়ে ছিলেন, তার বর্ণনা এসেছে
এভাবে :
‘তাহার রং এবং কারুকার্য দেখিয়া দুর্গামণি অত্যন্ত পুলকিতচিত্তে দাতার
ভূয়োঃ ভূয়োঃ যশোগান করিতে লাগিলেন। চুড়ি দুগাছি কাচের বটে, কিন্তু সেরূপ
মূল্যবান বাহারে চুড়ি পাড়াগাঁয়ে কেন, কলিকাতাতেও তখনো আমদানি হয় নাই।
বস্তুত তাহার গঠন, চাকচিক্য এবং সৌন্দর্য দেখিয়া মায়ের নাম করিয়া অতুল নিজের টাকাতেই বোম্বাই হইতে ক্রয় করিয়া আনিয়াছিল।’
আর বাংলা গানে এসেছে :
‘আমার চুড়ির রিনিক ঝিনিক রে
তার কাছে লাগত বড় বেশ।’
হ্যাঁ, চুড়ির আবেদন সব সময়ই ছিল। হয়তো থাকবে নানা আঙ্গিকে। তবে এক সময়
শুধু শাড়ির সঙ্গেই পরত ললনারা। তারা সোনা আর কাচের চুড়ি পছন্দ করতেন। এখন
সময়ের নিয়মে ‘সময়’ বদলে গেছে। তারপরও চুড়ির আবেদন কমেনি। বরং হাল ফ্যাশনের
অনুষঙ্গ হয়ে উঠছে চুড়ি নানান ফরমেটে-ডিজাইনে। যে কোনো পোশাকের সঙ্গে
ম্যাচিং করে পরা যায়Ñ এমন চুড়ি উদ্ভাবন হচ্ছে দিনকে দিন। বয়স দিয়েও এখন
চুড়িকে বাঁধার সুযোগ নেই। বিশ্বায়ন সব বয়সী নারীর জন্য চুড়ির দরজা খুলে দিয়েছে। তাই কাচের চুড়ির পাশাপাশি ফ্যাশন শোকেসে জায়গা করে নিচ্ছে নানা উপাদানের চুড়ি।
তবে কাচের চুড়ির রিনিঝিনি আওয়াজ আর বাহারি রঙের মিশেলে জড়িয়ে আছে
বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্য। শাড়ি বা সালোয়ার-কামিজ, পোশাক যাই হোক না কেন এখনো
অনেক আধুনিক তর”ণীর পছন্দের এক বিশেষ অনুষঙ্গ হচ্ছে কাচের চুড়ি।
অবশ্য
আজকাল সব কিছুতেই লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। প্রচলিত ধারার বাইরে আধুনিক
মানুষের আগ্রহ বেড়েছে নান্দনিকতার দিকে। তাই অতীতের সাদামাটা এক রঙের কাচের
চুড়িতে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে শিল্পের বাহারি ডিজাইনের ছোঁয়া। কাচের চুড়ির
পাশাপাশি এখন কাচের চুড়ির ওপর নানা রঙের পাথর, চুমকি, জরিসহ বিভিন্ন উপাদান
ব্যবহার করে আনা হচ্ছে নতুনত্ব।
আবার কাচের চুড়ির আধিপত্যে ধীরে ধীরে ভাগ বসাচ্ছে চৌকো, ত্রিকোণ,
ডিম্বাকৃতির প্লাস্টিক ও মেটাল চুড়ি। বস্তুত বাঙালি নারীদের এক অনন্য
অলঙ্কার হচ্ছে চুড়ি। এমন অনেক নারীই আছে যারা যে কোনো পোশাকেই চুড়ি পরেন।
চুড়ি ছাড়া তাদের দিনই কাটে না।
তবে আধুনিকতার কল্যাণে মেটাল, সুতা, চামড়া, ব্যাকেলাইট, রবার, কাঠ, মাটি, বিডস, পুঁতি, সিটি গোল্ডসহ নানা ধরনের চুড়ির ব্যবহার বাড়ছে।
এক সময় চুড়ি প্রধানত কাচ থেকে তৈরি হতো। তবে শামুকের খোল, তামা, ব্রোঞ্জ, সোনা ও হাতির দাঁতের চুরিও তখন ছিল।
অন্যসব উপাদান দিয়ে চুড়ি তৈরির কারণ এবং হাল ফ্যাশনের চুড়ির উপযোগিতার
কথা ফ্যাশনবিদদের ঠোঁটের ডগায় লাফায়, ‘আসলে কাচের চুড়ি ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা
থাকে। তাই অন্যান্য টেকসই উপাদানে তৈরি চুড়ির চিš—া আসছে। পরিবর্তনের ঢেউ
লেগেছে রুচিবোধেও। কারণ পার্বতীর মতো হাত ভর্তি চুড়ি এখন সবাই পরতে চান না।
আবার হাতে মাত্র বালা ধারণ করে অনেকে এখন তৃপ্তি পাচ্ছেন। আসলে কসমোপলিটন
পণ্য হয়ে যাওয়ার কারণে সব বয়সের নারীই চুড়ি পরছেন।’
বাঙালি নারীর সঙ্গে চুড়ির গভীর সখ্য ঠিক কবে সৃষ্টি হয়েছে, তার কোনো
প্রামাণ্য রেকর্ড আমাদের হাতে নেই। তবে চুড়ি পরতে ভালবাসেন সব বয়সী নারী।
উৎসবের দিন জমকালো সাজের সঙ্গে চুড়ি এখন অপরিহার্য হয়ে গেছে। বলা হচ্ছে,
হাতে চুড়ি না থাকলে সাজ ঠিক পরিপূর্ণতা পায় না। পত্রিকার বিশেষ পাতায়
বিভিন্ন উৎসবের পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে পছন্দসই চুড়ি পরার প্রেসক্রিপশন
হামেশাই চোখে পড়ে।
চুড়ির
রিনিঝিনি ছন্দ মনেও দোলা দেয়। হালে ফ্যাশনের নতুন প্রবণতা হচ্ছে সুতোর
চুড়ি। প্লাস্টিকের বালার ওপর নানা রঙের সুতো পেঁচিয়ে তৈরি হচ্ছে চমৎকার সব
সুতো-চুড়ি। সুতো ছাড়াও কাতান কাপড়ের লেস পেঁচিয়ে বানানো হচ্ছে রং-বেরঙের
চুড়ি। শাড়ি, কামিজ, ফতুয়া সব ধরনের পোশাকের সঙ্গে এ ধরনের চুড়ি মানানসই বলে
দাবি করা হয়।
আবার কপার, তামা, দস্তাসহ বিভিন্ন ধাতু দিয়ে তৈরি হচ্ছে বৈচিত্র্যময়
ডিজাইনের চুড়ি আর বালা। মাটি বা সিরামিকের নানা রং ও নকশা করা চুড়িও পাওয়া
যাচ্ছে। এসব চুড়ি নাকি দেশি সুতি বা ঁতাঁত কাপড়ের সঙ্গে বেশ মানায়।
কাঠ ও প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা ডিজাইনের চুড়ি ধীরে ধীরে জায়গা
করে নিচ্ছে। মোটা, চিকন, বাঁকা অবয়বে বিভিন্ন কাঠের চুড়ি চোখে পড়ে। কাঠ
দিয়ে আবার ব্রেসলেটও তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে গোলাকার ছাড়াও ঢেউ খেলানো,
বাঁকা, ত্রিভুজ, ষড়ভুজসহ নানা আকৃতির প্লাস্টিকের চুড়ি পাওয়া যাচ্ছে মোটা
আর চিকন ডিজাইনে। স্কার্ট, টপস, ফতুয়া-জিনসের সঙ্গে ম্যাচিং করে কাঠ ও
প্লাস্টিকের তৈরি এসব চুড়ি তৈরি হচ্ছে। জয়পুরি, মাল্টি, কাসুটিসহ নানা
ধরনের চুড়ির কথাও শোনা যায়। মুক্তার চুড়ির চাহিদাও বাড়ছে। বিভিন্ন ফ্যাশন
হাউসও তৈরি করছে নানা ডিজাইনের ফ্যাশনেবল চুড়ি।
বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে চুড়ির প্রচলন রয়েছে। এটা চেকে naramek,
ডাচে enkelring, ফিনিশে rannerengas, জার্মানে armreif, হাঙ্গেরিয়ানে
karperec, ইন্দোনেশিয়ায় gelang, ইতালিয়ানে braccialette, মালয়ে gelang,
স্পেনিশে brazlete ও তুর্কিতে halhal, তামিলে ভালায়ন, মালয়ালমে ভালা আর
নেপালিতে চুরা নামে পরিচিত।
ভারতীয় উপমহাদেশে চুড়ি ঠিক কবে চালু হয়েছে, তার সঠিক তথ্য কারো কাছে
নেই। তবে বিভিন্ন প্রত্নতাত্তিক খননকালে খোল, তামা, ব্রোঞ্জ, সোনা ও আকিক
পাথরের চুড়ি পাওয়া গেছে।
পাকিস্তানের মহেঞ্জোদারোতে (যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও ২৬শ বছর আগে) পাওয়া
এক মূর্তিতে দেখা যায়, নৃত্যরত এক বালিকার বাম হাতে চুরি রয়েছে। সম্ভবত তখন
দুহাতে চুড়ি পরার সংস্কৃতি ছিল না। অন্যদিকে মৌর্য সাম্রাজ্যের বিভিন্ন
ডিজাইনের চুড়ি পাওয়া গেছে ভারতের তক্ষশীলায়।
হীরা, মূল্যবান পাথর আর মুক্তো বসানো চুড়ির প্রচলন এখনো ভারতীয়
উপমহাদেশে রয়েছে। এক সময় লাক্ষার তৈরি চুড়িরও বেশ প্রচলন ছিল এখানে। আরব
উপদ্বীপের বিভিন্ন অংশেও চুড়ির প্রচলন রয়েছে।
বিয়ের চুড়ি সাধারণত রঙিন হয়ে থাকে। লাল রঙের চুড়ি হচ্ছে ‘জীবন ও আনন্দের
প্রতীক’ আর সবুজ রঙের চুড়ি হচ্ছে ‘উর্বরতার প্রতীক’। চুড়ি দুই হাতে পরা
যায়। এক হাতে পরতেও বাধা নেই।
আধুনিক
প্রজন্মের তরুণ সমাজের একটি অংশ এখন বেশ আগ্রহ নিয়েই চুড়ি পরছে। তবে তাদের
এই চুড়ি ‘খাড়–’ নামে পরিচিত। এটা রবার অথবা ধাতুর তৈরি হতে পারে। পশ্চিমা
সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের উঠতি তরুণরা এটা পরছে।
গিফট আইটেম হিসাবেও চুড়ি বেশ আদরণীয়। কারণ নারীরা শাড়ি বা জামার সঙ্গে ম্যাচিং করে চুড়ি পরতে এখন বেশ সচেতন।
চুড়ি নিয়ে কুসংস্কারও আছে। বলা হয়, চুড়ির কারণে স্বামীর নিরাপত্তা যেমন
বাড়ে, তেমনি ভাগ্যও ফেরে। আবার চুড়ি অকারণে ভেঙে গেলে স্বামীর বিপদ ঘটে।
আমাদের দেশে বৈশাখে লাল-সাদা বিভিন্ন বর্ণের রেশমি চুড়ি পরে নিজেকে
নানাভাবে সাজানোর প্রবণতা নারীদের মাঝে এখন স্বাভাবিক ব্যাপার। আবার তারাই
ভিন্ন উৎসবের দৈনন্দিন পথচলায় দেশপ্রেমের বহির্প্রকাশ ঘটাচ্ছেন পতাকার রং
মিলিয়ে লাল-সবুজ রঙের হাত ভরা চুড়ি পরে। প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে প্রতিটি
উৎসবেই বাঙালি নারী চুড়ি সাজের জন্য বেছে নিচ্ছে বিশেষ বিশেষ রংকে
প্রাধান্য দিয়ে তৈরি চুড়ি।
হাতভরা চুড়ি পরা বাঙালি সংস্কৃতির একটি অংশ। ফ্যাশনবিদরা বলেন, হাতের
গড়নের সঙ্গে মিলিয়ে দুহাত ভরা চুড়ি হাতের সৌন্দর্য যেমন বাড়িয়ে দেয়, তেমনি
সাজকেও করে পরিপূর্ণ।
একবার এক মহিলা তার স্বামীর সঙ্গে শপিং করতে গেছে। এক পর্যায়ে ওই উন্নাসিক মহিলা এক সেট চুড়ি পছন্দ করল।
‘তুমি এত চুড়ি কেনো। অথচ কোনদিন পরতে দেখি না’ স্বামী অনুযোগের সুরে বলল।
‘চুড়ি পরলে ভেঙে যাবে। তাই চুড়ি পরি না, শুধু কিনি’ মহিলার চটপট জবাব।
হাতপাখাবন্দনা
হাজার
হাজার বছর ধরে গ্রামবাংলার সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে হাতপাখা।
কবি-সাহিত্যিক, বাউল শিল্পীরা হাতপাখা নিয়ে বিভিন্ন গান, কবিতা ও গীত রচনা
করেছেন এবং তুলে ধরেছেন এটার সৌন্দর্যমণ্ডিত ঐতিহ্য। হাতপাখা নিয়ে মজার
মজার রূপকথা, গল্প-কাহিনীও আমাদের সমাজে প্রচলিত।
আমাদের সমাজে এক সময় হাতপাখা বলতে তালপাখাই বোঝাত। আর সংস্কৃতে তালপাখা
‘তালবৃন্তক’ নামে পরিচিত। পরে কাপড়, বাঁশ ও সুতো দিয়ে হাতপাখা বানানো শুরু
হয়। হাতপাখায় নকশা আর ডিজাইনের নতুন মাত্রা এসেছে। পদ¥, শতফুল, উনিশকাঁটা,
সঙ্কলন, বরফি, শিঙ্গারা, শক্সখ, আয়নাকোটা, শক্সখপদ¥, ঝুরিফুল, চালতা ফুল, পানপাতা, তারাফুল,
চারমাছ, হাতিবান্ধা, মোরগ, চৌখুপি, চক্র নামে হাতপাখার নকশার কথা শোনা
যায়। কোনো কোনো নকশার মধ্যে আয়নার টুকরোও বসানো হয়। হাতলে লাগানো হয় বাঁশের
একটি নল, যাতে হাতপাখা ঘোরাতে কম বেগ পেতে হয়।
অন্যদিকে বাংলা একাডেমীর ‘লোকশিল্প’ গ্রন্থে হাতপাখা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে
‘উষ্ণমণ্ডলে অবস্থিত এদেশে খর বৈশাখের দাবদাহ এবং ভাদ্রের আর্দ্রতা
মিশ্রিত গরমে হাতপাখা মানুষের নিত্যসঙ্গী। সুতা, বাঁশ, চুলের ফিতা, বেত,
খেজুরপাতা, নারকেলপাতা, তালপাতা, কলার শুকনো খোল, পাখির পালক, সুপারির খোল,
শোলা, গমের ডাঁটা, মোটা কাগজ প্রভৃতি পাখার উপাদান। এ নিত্যব্যবহার্য
বস্তুটি বিশেষ করে মেয়েদের হাত পড়ে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। সুতা,
বাঁশ, সরতা বেত ও কলার খোলের শুকনা বেতি দিয়ে পাখা বোনা হয় পাটি বা ম্যাট
বোনার কায়দায়। বিভিন্ন মটিফ বা ডিজাইনে এ পাখা তৈরি হয় এবং এগুলোর বিভিন্ন
নামও রয়েছে। এর মধ্যে পানগুছি, কেচিকাটা, তারাজো, পুকুই রাজো, ধানছড়ি, ফলং
ঠেইঙ্গা, ফড়িংয়ের ঠ্যাং, রাবণকোডা, নবকোডা, কবুতর খোপ, মাকড়ের জাল, পদ¥জো,
কামরাঙ্গা জো, ধাইড়া জো, সুজনি জো, চালতা ফুল, কাগজ কাটা, হাতি, মরিচ ফুল,
আটাসান, শক্সখলতা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য’।
কাপড় ও সুতো দিয়ে হাতপাখা বানাতে গেলে প্রথমে বাঁশের কাঠি দিয়ে বৃত্ত
তৈরি করে নিতে হয়। এর ওপরেই সুতো অথবা কাপড়ের নানা বুনন। বৃত্তের পরিধিতে
জুড়ে দেওয়া হয় রঙিন কাপড়ের ঝালর।
গরমে অতিষ্ঠ ইংলিশ বেনিয়ারা এ দেশে ল¤¦া কাঠের সঙ্গে লাল শালুতে কিনার
মোড়ানো পাটি জুড়ে দিয়ে আংটা লাগানো আর ছাদে ঝোলানো বিশেষ পাখা উদ্ভাবন
করেছিলেন। দূরে বসে দড়ি বাঁধা এই পাখা যারা মৃদুলয়ে টা
হাতপাখা
নতেন তাদের বলা হতো ‘পাক্সখাবরদার’। এক সময় আদালতের এজলাসেও এসব পাখা দেখা যেত।
তবে বর্তমানে লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণার কারণে হালে হাতপাখা পল্লীজীবন ছাপিয়ে নগরজীবনেও বেশ পোক্ত স্থান করে নিচ্ছে।
নিত্যদিনের ব্যবহারের জন্য এক সময় বাঁশ অথবা তালপাতার ডাঁটিতে বোনা
তালপাখাই ছিল গরমে স্ব¯ি— পাওয়ার সম্বল। তবে বহনে অসুবিধা থাকায় নগরজীবনে
ফোল্ডিং হাতপাখার প্রচলন বাড়ে। কথাটাকে আরো সহজভাবে বললে এভাবে বলা হয়,
দৃষ্টিনন্দন চীনা হাতপাখার কাছে দেশি হাতপাখা টিকে উঠতে পারছে না।
শিক্ষার্থীরাও এখন বইয়ের ঝোলায় ফোল্ডিং হাতপাখা বহন করছে। বিশেষত অসহ্য রোদ
আর ভ্যাপসা গরমে ব্যাগে এই জাতীয় পাখা রাখার ফায়দা অনেক। পাবলিক বাসেও এখন
অনেককে হাতপাখা বুলোতে দেখা যায়।
হাতপাখায় জড়িয়ে আছে আমাদের ঐতিহ্য ও আভিজাত্যও। বৈশাখী মেলা থেকে শুরু
করে যে কোনো বাঙালি উৎসবেই হাতপাখার থাকে আলাদা কদর। গরমে আরাম পাওয়াই
হাতপাখার মৌল উদ্দেশ্য হলেও প্রযুক্তি ও ফ্যাশনের উৎকর্ষে এটি ধারণ করছে
শৈল্পিক রূপ।
এক সময় জমিদার বাড়ির হাতপাখাগুলো হতো ঝালর লাগানো এবং বিশাল আকৃতির।
সেসব পাখা রেশম বা সাটিনের কাপড়ের ওপর সুতা, জরি এমনকি সোনা-রুপা দিয়েও কাজ
করা থাকত। এখন অনেকের ড্রয়িংরুমে নানা ডিজাইনের হাতপাখা শোপিস হিসাবে
ব্যবহৃত হয়।
প্রাচীন কারুশিল্প হাতপাখার যাত্রা কোথায় এবং কাদের মাধ্যমে ঠিক কবে
শুরু হয়েছিল সেটা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। তবে ভ্যাপসা গরমে হাতপাখা
নাড়িয়ে বাতাসে দোলাচল সৃষ্টি গরম হাওয়া সরিয়ে অপেক্ষাকৃত শীতল হাওয়া
প্রবাহের উদ্দেশ্যেই হাতপাখার ব্যবহার শুরু হয়েছে বলে মনে করা হয়। আর গরমে
এটার উপযোগিতা প্রমাণিত হওয়ার পর সময়ের ব্যবধানে এটা রূপান্তরের পথ বেয়ে
একটি অলঙ্করণময় শিল্পে পরিণত হয়। এখনো ধর্মীয় ও রাজকীয় অনুষ্ঠানে
কারুকাজমণ্ডিত হাতপাখার প্রচলন রয়েছে।
প্রত্নতাত্তিক সাক্ষ্য থেকে ধারণা করা হয় ভারতবর্ষ, চীন, জাপানসহ
প্রাচ্যের কয়েকটি দেশে হাতপাখার ব্যবহার ছিল। আবার প্রাচীনকালে
মধ্যপ্রাচ্যে পশুর চামড়ার তৈরি অলঙ্কৃত হাতপাখার সন্ধান পাওয়া গেছে। এটার
হাতলে গাছের ডালের অংশ অথবা পশুর হাড় লাগানো থাকত।
এক সময় গ্রামের ললনারা হাতপাখা তৈরি করে রঙিন সুতা দিয়ে ‘ভুলো না আমায়’
বা ‘যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভোলে না মোরে’- টাইপের ছন্দ লিখত। আবার
রোদেলা দুপুরে দুরন্ত কিশোর দলের হাতে শোভা পেত কারুকাজের তালপাখা। আর
মধ্যবয়সী ও বৃদ্ধরা গাছের ছায়ায় বসে তালপাখা হাতে বাতাস করতে করতে দূরের
রাখাল ছেলেটির বাঁশির সুর শুনত।
অন্যদিকে ক্লান্তপরিশ্রান্ত কৃষক মাঠ থেকে ফেরার পর কিষাণী ব্যস্ত হয়ে পড়ত হাতপাখার শীতল পরশে তাকে জুড়িয়ে দিত।
আসলে হাতপাখার প্রতিটি পরতে পরতে লুকিয়ে থাকতে পারে গ্রামীণ নারীর
আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ নাম না জানা কত্ত কাহিনী। হাতপাখা বুনন ছিল আবহমান
গ্রামবাংলার চিরাচরিত অতি পরিচিত দৃশ্য। প্রযুক্তি আর যান্ত্রিকতার দাপটে
নাগরিক জীবনে হাতপাখার প্রচলন এখন কমে গেছে। তারপরও ভয়াবহ লোডশেডিংকালে
বিপর্যস্ত নগরবাসী ক্ষণিকের জন্য হলেও মনে করেন হাতপাখার শীতল পরশ বা
বাতাসের কথা। কেউ কেউ অসহ্য গরমে স্বস্তি পেতে এখনো হাতপাখার দ্বারস্থ হন।
আজকাল হাতপাখা ফ্যাশনের উপাদানে পরিণত হয়েছে। তালপাখার পাশাপাশি বাহারি
রং ও ডিজাইনে প্লাস্টিক, বেত, ব্যাকেলাইট, কাগজ দিয়ে হাতপাখা তৈরি করা হয়।
এছাড়া অধিকাংশ হাতপাখার হাতল হিসাবে জুড়ে দেওয়া হয় বাঁশের চিকন কাঠি, বেত
অথবা লাঠি। তবে আজকাল কাপড় ও সুতার কারুকার্যমণ্ডিত বাহারি ধরনের হাতপাখা
পাওয়া যাচ্ছে। এতে যুক্ত হচ্ছে হরেক রকমের রং ও সুতা, ফলস, শাড়ির পাড় ও
লেস।
‘আমার নাম তালের পাখা শীতকালে দেই না দেখা, গ্রীষ্মকালে প্রাণের সখা’- এটি
আমাদের দেশের গ্রামবাংলার একটি পুরনো প্রবচন। এখনো গরমে আমরা হাতপাখার ওপর
নির্ভরশীল। চাহিদা থাকায় অভিজাত বুটিক বাড়ি কিংবা ফ্যাশন হাউসগুলোও নজর
দিচ্ছে বাহারি হাতপাখার ওপর। এসব হাতের পাখা নানা ঢং আর রঙে চলে আসছে
অভিজাত ড্রইংরুমের সৌন্দর্য বাড়ানোর উপকরণ হয়ে।
একাধিক দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, বর্তমানে চট্টগ্রামের
চন্দনাইশ উপজেলার দক্ষিণ জোয়ারা গ্রামের হাতপাখা এখন বিদেশেও রফতানি
হচ্ছে। মান ভালো হওয়ার কারণে দেশের বিভিন্ন স্থান ছাড়াও সৌদি আরব,
জার্মানি, দুবাই, ভারত, পাকিস্তানসহ বিশ্বের আরো কয়েকটি দেশে এখানকার পাখার
চাহিদা বাড়ছে।
বোশেখের কাঠফাটা রোদে লোডশেডিং নগর জীবনে উত্তাপ বাড়ায়- দিনে রাতে
সমানে। মাথার ওপর তিন পাখাওয়ালা যন্ত্রটা নিশ্চল ঝুলে থাকে। ঘামভেজা
দেহটাকে এক বিন্দু স্বস্তি দিতে সবার চোখ যায় হাতপাখাটার দিকেÑহোক না তা
তালপাতা, কাপড়, প্লাস্টিক, প্রক্রিয়াজাত কাঠ অথবা কাগজের। অসহ্য গরমে
হাতপাখাই হয়ে গেছে দিনে-রাতের সঙ্গী। হাতপাখা ছাড়া নগরজীবন চলে কী করে?
২০১১ সালের নববর্ষের একটি বাড়তি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বিনে পয়সায় কাগজের
হাতপাখা বিতরণ। এটার মানবিক দিক থাকলেও পণ্যের বিজ্ঞাপনই ছিল মুখ্য। রমনা,
চারুকলা, টিএসসি, শিল্পকলা প্রান্তর ঘুরে দেখা গেছে, সিঙ্গার, ইমাম
টেলিকমসহ কমপক্ষে ১৫টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বিনে পয়সায় কাগজের হাতপাখা
বিলিয়েছে। এক সময় এ দেশে তালপাখার ব্যাপক প্রচলন ছিল। বাঁশ, বেত ও কাপড়
দিয়েও তা তৈরি হতো। কিন্তু ঠিক কবে এ দেশে হাতপাখার প্রচলন হয়েছিল, তার
কোনো লিপিবদ্ধ বা প্রত্নতাত্তিক প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। মুঘল আমলে
হাত-টানা পাখার প্রচলন দেখে এটা অনুমান করা যেতে পারে, পরবর্তীকালে জমিদার ও
উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোতে হাতটানা পাখার প্রচলন ঘটে।
পশ্চিমা বিশ্বসহ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে হাতপাখা ফ্যাশন সামগ্রী হলেও
আমাদের দেশে তা নয়। বিদ্যুতের কল্যাণে নগরজীবন থেকে হাতপাখা বিদায় নিয়েছে।
কিন্তু লোডশেডিংই হাতপাখাকে নগরজীবনে ফিরিয়ে আনছে। হাতপাখা মূলত কুটির
শিল্প হলেও হালে প্লাস্টিকের হাতপাখা চোখে পড়ে। তারপরও এটা সুসংঘবদ্ধ
শিল্পে পরিণত হতে পারেনি। তাই দেশে এ পণ্যটির চাহিদার প্রকৃত পরিসংখ্যান
জানার উপায় নেই। তবে লোডশেডিং এ শিল্পের পুনরুজ্জীবনে ভ‚মিকা রাখছেÑ এমন
দাবি একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। লোডশেডিং অভিশাপ কাটানো গেলে হাতপাখা
আমাদের ফ্যাশন পণ্য হয়ে যেতে পারে।
বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে বাংলাদেশিদের জীবনে হাতপাখার প্রচলন বাড়ছে।
লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা আর কাঁহাতক সহ্য করা যায়? তপ্তদেহে এক চিলতে শাšি—র
পরশ বুলাতে হাতপাখার বিকল্প নেই।
বিশ্বে শিল্প, হাতির দাঁত, পশুর হাড়, মাইক, চন্দনকাঠ, মুক্তো এমনকি কচ্ছপের খোল দিয়েও হাতপাখা তৈরির প্রমাণ রয়েছে।
জাপানে হাতপাখার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্য অনেক। ওখানে এটা বন্ধুত্ব,
শ্রদ্ধা ও শুভ কামনার প্রতীক। জাপানি নাচেও হাতপাখার উপস্থিতি চোখে পড়ে।
ইতিহাসে রয়েছে, ১৫শ শতকে পর্তুগিজ বণিকরা চীন ও জাপান থেকে হাতপাখা
আমদানি করে পশ্চিমা বিশ্বে তা ছড়িয়ে দিয়েছে। ১৬শ শতকে চীনা ভাঁজ করা
হাতপাখা ইউরোপে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ফোল্ডিং ফ্যান হাতে ব্রিটেনের রানী প্রথম
এলিজাবেথের একটি প্রোর্ট্রেট এখনো রাজপরিবারে সংরক্ষিত রয়েছে। এ কারণে বলা
হয়, হাতের মুঠোয় ঠাঁই পাওয়া হাতপাখাই একটি জাতির ইতিহাস, ভূগোল ইতিহাসের
গল্প বলে। মিসর, ব্যবলিন, আজটেক, ইনকা, পারস্য, গ্রিক ও রোমান সভ্যতায়
হাতপাখার প্রচলন ছিল। তবে এটার আবিষ্কারক কারা, তা জানা যায়নি।
রেশম, পাখির পালক, হালকা ধাতু পাত দিয়েও হাতপাখা তৈরি হয়। এটাতে হ্যাড পেইন্টিংয়ের পাশাপাশি পুতি, ক্রিস্টাল ও ফিতা লাগানো হয়।
হাতপাখা নিয়ে প্রচলিত কৌতুক এ রকম :
একদিন এক সর্দারজি ট্রেনে চেপে কোথাও যাচ্ছিলেন। সেদিন ছিল প্রচণ্ড গরম।
তাই সর্দারজিসহ অনেকেই ফেরিওয়ালার কাছ থেকে হাতপাখা কিনে বাতাস করতে
লাগলেন। অথচ এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে যেতে না যেতেই সবার হাতপাখা খুলে
নষ্ট হয়ে গেল।
কিন্তু সর্দারজির হাতপাখাটা একদম নতুনের মতোই আছে। এটা দেখে অবাক হয়ে
একজন জিজ্ঞেস করলেন, ‘সর্দারজি, আপনার হাতপাখাটি এখনো নতুনের মতো আছে কী
করে?’ সর্দারজি বললেন, ‘আরে মশাই, আমি আপনাদের মতো বোকা নাকি? টাকা দিয়ে
হাতপাখা কিনেছি কি নষ্ট করার জন্য? আমি তো হাতপাখা মুখের কাছে ধরে শুধু
মাথাটা নড়াচড়া করেছি।’
0 comments:
Post a Comment