লিওনার্দো দা ভিঞ্চির অমর সৃষ্টি “মোনালিসা” এর কথা কে না জানে? অদ্ভুত সুন্দরী মোনালিসার প্রতিকৃতিটি বিখ্যাত হয়ে আছে কেবল তার অধরে মুচকি হাসির কারণে। তাছাড়া এ ছবিতে আশ্চর্যজনক আরো কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। লিওনার্দো ছবিটি এঁকেছিলেন ফ্লোরেন্সে ১৫০৩ থেকে ১৫০৬ সালের মধ্যে। তাঁর মডেল জানোবি দেল জিওকোন্দার স্ত্রী লা জিওকোন্দা। ভিন্চি’র মোনালিসা পৃথিবীর ৮৫ শতাংশ মানুষের চোখে সব থেকে বিখ্যাত এবং পরিচিত শিল্পকর্ম। এছাড়া পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত, এবং সবচেয়ে সমালোচিত শিল্পকর্মও মোনালিসা। রেনেসাঁর পুর্নজাগরণের শিল্পী, পৃথিবী যাকে জিনিয়াস বলে জানে সেই লিওনার্দো দা ভিন্চি’র আকাঁ মোনালিসা, কেনো এত বিখ্যাত বা আলোচিত বা সমালোচিত? এর পেছনে বছরের পর বছর গবেষক, শিল্পী ও শিল্পকলার ইতিহাসের পন্ডিতেরা ব্যয় করে যাচ্ছেন মূল্যবান সময়; নিশ্চয় কারণ আছে!
এই বিখ্যাত শিল্পকর্ম নিয়ে যত কাল্পনিক কাহিনী প্রচলিত আছে তা আর কোনো শিল্পকর্ম সর্ম্পকে নেই। যদি ভিন্চি , ভ্যান গো’র মত তারঁ কাজের সব বর্ণনা লিখে রেখে যেতেন তাহলে আজকে মোনালিসা সৃষ্টির ৫০০ বছর পরেও এত কল্পকাহিনী তৈরী হতো না। যাই হোক , এই সব কল্পকাহিনীও সাধারন মানুষের মনে মোনালিসাকে নিয়ে কৌতুহল এবং আরো জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে । যদিও সবচেয়ে প্রচলিত গুজবটি হচ্ছে, মোনালিসা আসলে ভিন্চির নিজেরই প্রতিকৃতি ।আর হলেই বা তাতে কি এসে যায় ? এতে করে মোনালিসার সৈন্দর্য্য কমবে না এক ফোটাও।
এ ছবিটি একে লিওনার্দো জগদ্বিখ্যাত হয়ে আছে। কিন্তু এ ছবিটি চুরি ই হয়ে গিয়েছিল এক সময়। এখন ছবিটি সংরক্ষিত আছে প্যারিসের লুভর মিউজিয়ামে। লিওনার্দো যখন ফ্রান্সে ইমিগ্রান্ট হন তখন সংগে নিয়ে আসেন ছবিটি। এখানে এটি বিক্রি হয়ে যায় ৪০০০ সোনার মুদ্রার বিনিময়ে। এটি তখন টানানো হয়েছিল ভার্সাই রাজপ্রাসাদে। সম্ভবত টুইলিরাইসে নেপোলিয়নের বেডরুমেও এটি টাঙ্গানো ছিল।
১৮০৪ সালে ছবিটি প্যারিসের লুভর গ্যালারিতে উপহার দেয়া হয়।১৯১১ সালে একদিন লুভর মিউজিয়ামে প্রতিদিনের মতো পাহারায় থাকা এক রক্ষী জানান যে “মোনালিসা” দেয়ালে যেখানে থাকার কথা সেখানে নেই। তিনি সম্ভবত আরেকজন রক্ষীর সাথে মজা করছিলেন। তারা আসলে এধরনের কিছু আশাই করেননি। কিন্তু সত্যি সেটা পরদিন যথাস্থানে টানানো ছিলো না। তারা ভেবেছিল হয়তো এটা ফটোগ্রাফের জন্য কিংবা কপি পেইন্টিং এর জন্য সরানো হয়েছে। পরদিন সকালে ল্যুভরের গার্ড ব্রিগেডিয়ার পাওয়ারবিন অফিসিয়ালি রিপোর্ট করে, তাঁর চিন্তাটি আগের মতোই থেকে যায় । সকাল ৯ টার দিকে চিত্রকর লুই বেরাউড এলেন, তিনি কপি করছিলেন মোনালিসা ছবিটি। তিনি এসে জিজ্ঞেস করলেন – ছবিটি কোথায়? ব্রিগেডিয়ার বলল, ফটোগ্রাফার এটি নিয়ে গেছে কপি করার জন্য। কিন্তু দুপুরের মধ্যেও যখন ছবিটি এলো না তখন সে ব্রিগেডিয়ারকে প্রভাবিত করলো অনুসন্ধান করার জন্য। অবশেষে লাল গার্ডরাও খবর নিয়ে এলো ছবিটি কোথাও খুজে পাওয়া যাছে না। দুঃখজনক সংবাদটি যেই দুপুরবেলা পৌছাল সংবাদপত্র অফিসে, হেডলাইনে লেখা বেরুল এক “অভাবনীয়” শিরোনাম। সাধারণ জনগণ এই মূল্যবান শিল্পসম্পদটিকে ভালোবাসতো মনপ্রাণ দিয়ে। তারা প্রথমে বিশ্বাস করেনি এই সংবাদটি সত্য।
পুলিশ তখন গোপনভাবে অনুসন্ধান শুরু করলো এবং অন্যান্য ছবি বুলেটপ্রুফ কাচের আবরণ দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো। ছবিটি খুজে দেবার জন্য “এক ইলাস্ট্রেশন” বিজ্ঞপ্তি ঘোষণা করে, যে এই ছবিটি এনে দিবে তাকে ৪০০০০ ফ্রাংক কোনরকম প্রশ্ন ছাড়াই দেয়া হবে। “প্যারিস জার্নাল” ঘোষণা করে ৫০০০০ ফ্রাংক। পুলিশ আরো সক্রিয় হয়ে উঠে এই অপরাধের উৎস সম্পর্কে। চোর সম্পর্কে ধারণা করা হলো তারা সারারাতব্যপি কাজটি করেছে এবং সম্ভবত এর সাথে যে জড়িত ছিল সে আগে থেকেই ছবিটির বাধানো আংটা আলগা করে রেখেছিল , যাতে চোর ছবিটির পিছনে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারে। সব লোক যখন চলে গিয়েছে তখন চোরটি নিরাপদে গার্ডের সহায়তায় করিডোর দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। এই ছবিটি চুরি যাওয়ার পর সারা পৃথিবীর মানুষ বিশেষত চিত্রকলা প্রেমিকরা বিক্ষোভ প্রকাশ করে। প্যারিসের অলিগলিতে এই বিষয়ে নানারকম গুজব ছড়াতে শুরু করে। জনগণের বিক্ষোভ এবং প্রতিবাদের কারণে ল্যুভর মিউজিয়ামের ততকালীন কিউরেটর থিওপেলি হোমলোকে বরখাস্ত করা হলো এবং মিউজিয়ামে কড়া নিরাপত্তা আরোপ করা হয়।
এ নিয়ে বিশ্বখ্যাত শিল্পী পাবলো পিকাসোর একটি ঘটনা রয়েছে। এক কবি গিয়োম এপিলিনেয়ার পিকাসোকে গোপনে বলেন, তাঁর কাছে মোনালিসার ছবিটি রয়েছে এবং সেটা বিক্রি করা হবে। পিকাসো যথারীতি ছবিটি কিনে নেন। কিন্ত তিনি পুলিশে খবর দিলে পুলিশ কবি গিয়োওকে গ্রেফতার করে। মজার ব্যপার হলো, সেটী আসল মোনালিসা ছিল না। এটা প্রমানীত হবার পর পুলিশ কবিকে ছেড়ে দেয়।
১৯১৩ সালে ,দুবছর পর ঘটনা অন্যরকম এক মোড় নেয় । নভেম্বরের এক সকালে আলফ্রোডা গ্যারি মোনালিসা কিনার একটি প্রস্তাব পান। তিনি একজন ইতালিয়ান আর্ট ডিলার। তিনি তাঁর বন্ধু “উফিজি গ্যালারি” এর কিউরেটর গিওভানি পোগিকে কথাটা জানান। তারা দুজনে মিলে সিদ্ভান্ত দেন যে প্যারিসের পত্রলেখকের সাথে যোগাযোগ করবেন। পত্রলেখকের নাম ভিনসেনজো পেরুগুয়ে । তাঁর সাথে দেখা করার পর এই পত্রলেখক তাদেরকে খাটের নিচ থেকে মোনালিসার মূল ছবিটি বের করে দেখান এবং ৫ লাখ লিও দাবী করেন। তিনি আসলে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন ছবিটি এতো সময় ধরে লুকিয়ে রাখতে রাখতে। ছবিটি দেখার পর পরই গ্যারি লুভর মিউজিয়ামে খবর পৌছে দেন। ১৫ দিনের মধ্যেই ভিনসেনজো ধরা পড়েন পুলিশের হাতে। মামলা চলতে থাকে। অবশেষে ৭ মাস পর ভিনসেনজো মুক্তিও পেয়ে যায়।
ইতালির সকল শহরে তখন ছবিটি দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। পরে আবার ফ্রান্সের লুভর মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ ছবিটি ফেরত নিয়ে যায়।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস এক আর্টিকেলে বলে – ১৯০৬ সালে এর ৩ শতাংশ সুদ বেড়ে এর দাম হয় ১,৬২৯,৫২৮,০৬২ ডলার। প্রতিমিনিটে এর সুদের পরিমাণ ৯৪.৩০ ডলার। বর্তমান সময় পুরো প্যারিস শহরকে বিক্রি করে দিলেও মোনালিসার দাম পরিশোধ হবে না।
প্রতিদিন শুধুমাত্র মোনালিসা দেখতে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভীড় করছে ল্যুভর মিউজিয়াম এ। শুধুমাত্র মোনালিসা‘র সামনে লম্বা এক লাইন। প্রতিটা দর্শক মাত্র ৩০ সেকেন্ড করে সময় পায় এই বিখ্যাত শিল্পকর্মটি দেখতে। ঠিক ২০০৫ এ এপ্রিলের ৪ তারিখে মোনালিসাকে আলাদাএকটি রুমে সরিয়ে ফেলা হয়। ল্যুভ এ শুধুমাত্র মোনালিসাই দুই পরত বুলেটপ্রুফ কাচে বাধাই করে রাখা, সেই ১৯৭৪ সাল থেকে।
এর পরেও কত ধরনের দূর্ঘটনার শিকার হয়েছে এই অসাধারন শিল্পকর্মটি। চুরি করে নিয়ে যেতেও দ্বিধা করেনি। কিন্তু মোনালিসাকে চুরি কে করবে? কার এত সাহস? কারো নেই। কারণ মোনালিসা যে কোনো শিল্প কর্ম নয়। একে কেউই চুরি করে বা অসৎ উদ্দেশ্যে আটকে রাখতে পারবে না। এমনি এক আধ্যাত্মিক শক্তি কাজ করে মোনালিসা‘র মধ্যে।
মোনালিসাকে ভিন্চি গড়েছে ৩ বছরেরও বেশী সময় ধরে, যতদূর মনে পড়ে। মোনালিসা সেই সময় অভিজাত পরিবারের সদস্য ছিলো কোনো সন্দেহ নেই। সেই সময় চোখের ভুরু কেটে ফেলা অভিজাত মহিলাদের ফ্যাশনের অংশ ছিলো। সে কারনেই মোনালিসা‘র চোখের উপরে কোনো ভুরু দেখা যায় না , বা ভিন্চি ভুরু একেঁছিলো , চিত্রটি পরিস্কার করতে গিয়ে বা , সময়ের আস্তরে চাপা পড়ে গেছে । ভুরু থাক বা না থাক মোনালিসা এমন এক অমর সৃষ্টি যে , ভিন্চির খ্যাতিকেও বাড়িয়ে দিয়েছে বহু মাত্রায়।
লিওনার্দো মোনালিসা কে একেছে যে পদ্ধতিতে তাকে বলা হয় ’স্ফুমার্তো’।
তাতে করে এই প্রথম কেউ আকঁতে পারে এমন ভাবে যে মনে হয় রক্ত মাংসের মানুষ। এই প্রথম কোনো জীবন্ত পতিকৃতি আকঁলো। যেন মোনালিসা‘র চামড়ার নিচে রক্ত চলাচল দেখা যাবে। এমনি জীবন্ত এক ছবি। যেনো নড়ে চড়ে বসে,কথা বলে উঠবে।
মোনালিসা চেয়ারে বসে একটু ঘুরে এমন ভাবে দর্শকের দিকে তাকিয়ে আছে যেন তাকে কেউ ডেকেছে বা সে কারো সাথে কথা বলতে চাইছে। আমরা মোনালিসা‘র শরীরে উপরিভাগের তিন চতুর্থাংশ দেখতে পাই। তার দুই হাত চেয়ারের হাতলে এমন আলতো ভাবে রাখা যেনো সে গান শুনছে বা বাইরে কিছু দেখছে উদাস দৃষ্টি দিয়ে । মোনালিসা’র উদাস করা চোখ ও ঠোটের কোনে মৃদু হাসিই মোনালিসা‘কে করে তুলেছে রহস্যময়ী।
মোনালিসা এমন এক নারী চিত্র, যে কিনা শিল্পকলার ইতিহাসের অনান্য বিখ্যাত নারীদের মত নগ্ন নয় , বা তাকে কামুকভাবেও ফুটিয়ে তোলা হয়নি। সে ফুলহাতা গাউন পরা , যার গলা ও ঘাড় দৃশ্যমান শুধু, কোনো অলংকারের চিহ্নও নেই। হাতের আঙ্গুলগুলো দেখা গেলেও তাতে কোনো আংটি নেই , যে প্রমানিত করবে যে সে বিবাহিত ছিল। কেও বলে মোনালিসা ছিলো, সুখী বিবাহিত রমণী , যে কিনা গর্ভবতী। কেও বলে মোনালিসা ছিলো অসুখী , তাই তার দৃষ্টি ছিলো উদাস।
তার সৃষ্টিকর্তা লিওনার্দোর অর্ধেক অংশ সে । মৃত্যূর পরে লিওনার্দোর রেখে গেছে মোনালিসার ভেতরে তার আত্মাটুকু । তাই আজো আমরা মোনালিসার মাঝে খুজেঁ পায় ভিন্চির আত্মা , তাইতো এত জীবন্ত সে এবং এত বিখ্যাত।
পৃথিবী যতদিন থাকবে ভিন্চি ও মোনালিসাও তত দিন যেনো বেচেঁ থাকে।
0 comments:
Post a Comment