আমি ভূত দেখিনি, কিন্ত্ত ভূতের ভয় পেয়েছিলাম৷ তোমরা ভাবছ এ আবার কেমন কথা৷ কী আশ্চর্যের কথা না! ভূত দেখিনি, অথচ ভূতের ভয়৷ তাহলে খুলেই বলি৷ গত জুলাই মাসে আমার মামার বিয়ে হল৷ কলকাতা থেকে মামার বাড়ি অনেক দূর৷ উল্টোডাঙা থেকে ট্রেনে উঠে সেই দূরে বনগাঁয় নেমে ভ্যানে করে ইছামতী নদী পেরিয়ে, তারপর বাসে করে গোবরাপুর গ্রামে যেতে হয়৷ মামার বাড়ি প্রচুর গাছপালায় ভর্তি৷ আর গৃহপালিত পশু তো আছেই৷ অনেক পাখির এক সঙ্গে গুঞ্জন হয় এত ভালো লাগে, তোমাদের কী বলব৷
তো যাই হোক বিয়ের দিন সকাল-সকাল আমরা পৌঁছে গিয়েছি৷ রাতে বিয়ে হয়ে গেল৷ পরের দিন বাসি বিয়ে৷ সন্ধেয় মামা-মামীকে নিয়ে চলে এল৷ তার আগে অবশ্য সকালে আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন বাড়ি চলে গিয়েছে৷ মামার বাড়ি মোটামুটি ফাঁকাই হয়ে গেল৷ জুলাই মাস বর্ষার সময়৷ সন্ধে থেকে হল কি ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি৷ কখনও বৃষ্টির তেজ বাড়ছে, কখনও কমছে৷ আমরা যে ঘরটায় রাতে থাকব তার ছাদ পাকা৷ কিন্ত্ত উঠোনের অন্য দিকে রান্না ঘর টিনের চাল দিয়ে ছাওয়া৷ যখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে তার শব্দ আমার বেশ সংগীতের সুরের মতোই মনে হল৷ রাত বাড়ছে বৃষ্টি কমে না মাঝে মাঝে বিদ্যুত্ চমকানো, ঝড়ের মতো হাওয়া বইছে৷ এর মধ্যে দিদু রাতের খাবার তৈরি করে ফেলেছেন৷ রাতের খাবার খেতে খেতেই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল অর্থাত্ কারেন্ট চলে গেল৷ তার মধ্যে খাওয়া শেষ করে আমরা সবাই শুয়ে পড়লাম৷ কত রাত হবে জানি না৷ হঠাত্ আমার ঘুম ভেঙে গেল৷ টয়লেট যাব, সুইচ অন করে আলো জ্বলল না৷ বুঝলাম কারেন্ট আসেনি৷
মামার বাড়ির টয়লেট উঠোনের এক পাশে৷ আগেই বলেছি মামার বাড়ি গাছপালায় ভর্তি৷ গাছ থেকে বড় বড় জলের ফোঁটা পড়ছে৷ কাউকে ডাকলাম না৷ একটা ছাতা নিয়ে টয়লেট গেলাম৷ হঠাত্ বাইরে কীসের একটা আওয়াজ হল৷ আমি কান খাড়া করলাম বোঝার চেষ্টা করলাম শব্দটা কোন দিক থেকে আসছে৷ কখনও খসখস কখনও ঝনঝন, শব্দের তীব্রতা ক্রমশ বাড়ছে৷ আমার ভূত দেখা হয়নি বটে, কিন্ত্ত মা এবং ঠাম্মির কাছে অনেক ভূতের গল্প শুনেছি৷ সেই থেকে আমার মনে একটা ভীতি রয়েই গিয়েছে৷ ক্রমশ সেই ভীতি আমার মনে সঞ্চারিত হতে শুরু করল৷ আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে৷ তবুও আমি উঠে দাঁড়ালাম৷ টয়লেটের দরজা একটু ফাঁকা করে বাইরে দেখার চেষ্টা করলাম শব্দটা কোথা থেকে আসছে৷ দেখি উঠোনের অন্য দিকে রান্না ঘরের মাটির বারান্দার একপাশে লাল পেড়ে সাদা শাড়ির এক মহিলা বসে আছে৷ মাঝে মাঝে মনে হল হাতের দিকটা নড়ছে, পায়ের দিকটা নড়ছে৷ আমি ভাবলাম এই রাতে কে বসে আছে, বসে সে কীই বা করছে? আমার হাত পা আরও ঠাণ্ডা হতে শুরু করল৷ তাহলে ঠাম্মির কাছে শোনা ভূত কী এরকমই? ভাবতে ভাবতে সেই লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরা মহিলার পায়ের দিকটা খুব জোরে নড়ে উঠল৷ তারপরই তড়াং করে এক কালো বিড়াল উঠোনে লাফ দিয়ে পড়ল৷ আবছা অন্ধকারে দেখলাম রান্না ঘরের বারান্দা দিয়ে আর একটা কি চলে গেল৷ আমি মা গো, বাবা গো বলে চিত্কার করে উঠলাম৷
আমার চিত্কার শুনে বৃষ্টির মধ্যে সবাই ছুটে এল৷ সবাই বলতে লাগল 'কী হয়েছে কী হয়েছে?' আমি লাফ দিয়ে টয়লেটের দরজা খুলে লাফ দিয়ে মায়ের কোলে উঠে পড়েছি৷ ততক্ষণে আমার কান্না এসে গিয়েছে৷ ধীরে-ধীরে সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম৷ দাদু তখন হো-হো-হো করে হাসতে লাগল৷ আমার খুব রাগ হল৷ আমি ভয়ে মরছি আর দাদু কিনা হাসছে? এরপর দাদু আমাকে কোলে নিয়ে রান্না ঘরের বারান্দায় গেল৷ লাল পেড়ে সাদা শাড়িতে হাত দিয়ে টেনে সবার সামনে ফেলল৷ আমি অবাক হয়ে দেখলাম ঘুঁটের একটা স্ত্তপ করা রয়েছে৷ তারপর দিদু বলতে লাগল, 'রাতে খাওয়া দাওয়ার পর থালা বাসন ধোয়া হয়নি, সেগুলো ঘুটের স্তুপের পাশে রাখা রয়েছে৷ তাই মাছের কাঁটা থেকে ওই বিড়ালটা ওখানে এসে থালা বাসনে জিভ দিয়ে চাটছিল৷' দাদু আবার হো-হো-হো করে হেসে বলতে লাগল 'বিড়ালটা লাফ দিয়েছিল কেন জানিস? কেলোও মাছের গন্ধে ওই সময়ে ঘুটের স্তুপের পাশে চলে এসেছে৷ বিড়াল কুকুরকে দেখে ভয় তো পাবেই৷ তাই বিড়ালটা মেরেছে এক লাফ আর তুমি চিত্কার করে উঠলে৷ তার আগে বলি লাল পেড়ে সাদা শাড়িটা কেন নড়ছিল? বিড়ালটা মাঝে মাঝে এদিক ওদিক ঘুরে থালা বাসনের কাছে যাচ্ছিল৷ তখন ওর শরীর আর লেজ কাপড়ে লেগে নড়ছিল৷ আর তুমি ভেবেছ একটা মহিলা ভূত রান্না ঘরের সামনে অন্ধকারে বসে কী করছে? তুমি তাকে ভূত ভেবে নিয়েছ৷' সবাই তখন হো-হো-হো করে হেসে উঠল৷ আমি তখন মায়ের কোলে গিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম৷ আমার ভূতের ভয়ের গপ্পোটা কেমন লাগল বলতো? তাহলে সত্যিই কী ভূত আছে? আমাকে জানিও কিন্ত্ত৷
0 comments:
Post a Comment