নারীর বুকের শীত


অ.

চাকরির ইন্টারভিউ দিতে বের হওয়ার সময় মবিন দরজায় উষ্টা খায়।



মবিন গ্রামের প্রায় অসচ্ছল পরিবারের একমাত্র ছেলে। জন্মসূত্রে সেতারবাদক, তার সুরে গ্রামের সব পাখিরা তার উঠোনে এসে জড়ো হতো। সে শহরে আসে কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার উদ্দেশ্যে। তো, কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হলে থাকতো সে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর তার বন্ধুদের লগে মেসে উঠতে হয়। জীবন যাপনের খরচ তো কম না এই ঢাকা শহরে, ফলে, অন্তত বেঁচে থাকার প্রয়োজনে একটা চাকরি তার খুব প্রয়োজন হয়ে পড়ে। যেহেতু তার বাবা অবসর জীবন যাপন করেন, ফলে সংসারের হাল ধরার জন্যেও তার একটা চাকরি খুব দরকার। নাকি এ সবের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল তার একটা চাকরি পাওয়া, কেননা, সে তো শিরিনকে বিয়ে করতে চেয়েছিল।



আমাদের মবিনের সেতারবাদন, সা রে গা মা, খুব ভোরে সুর ওঠে সপ্তাকাশে। এই গল্পে অবশ্য তার এই সেতার প্রতিভা অপ্রাসঙ্গিক, কিংবা গল্পের বাইরের এই শহুরে জীবনে। বিপ্লবীদের পুঁজিবাদী সমাজে সে সেতার বাজানোর সাধে ভৃত্য হতে চেয়েছিল।



এখানে শুধু প্রাসঙ্গিক, মবিন কি চাকরিটা পায়? হয়তো সে চাকরিটা পায়, অথবা পায় না; তবু এখানেই এ গল্পের শুরু।



আ.

শিরিন মবিনের ক্লাসমেট, একসাথে পড়াশোনা; যেন সে মবিনের হাতে পাওয়া এক আরবান সেতার। একসাথে থাকার স্বপ্ন দেখতো কি তারা কোনো পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে? শিরিন শহরে থাকা মেয়ে, মবিনের গ্রাম্য সরলতা হয়তো তাকে আকর্ষণ করতো, মবিন যে সেটা উপভোগ পারে নাই তা তো না। ফলে, তারা ভালোবাসে, বিয়ে করতে চায় তারা তারা। যেহেতু বিয়ে করার আগে মবিনের চাকরি পাওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়ে, তাই মবিনের চাকরি না হওয়া পর্যন্ত শিরিন অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। মবিন সেই সেতারে ছেলেভুলানো সুর তুলতে থাকে নাকি ততদিন? কিন্তু, চাকরির ইন্টারভিউ দিতে বের হওয়ার সময় মবিন দরজায় উষ্টা খায়।



তো যাই হোক, অবশেষে হয়তো মবিন চাকরিটা পায়। তারপর সে শিরিনকে বিয়ে করে। গ্রামে মায়ের কাছে টাকা পাঠায় সে, বোনের বিয়েতে গয়না গড়তে দেয়। গ্রামে দু একটা ছোট জমিও হয়তো রাখে সে, বৃদ্ধ বাবার মুখে হাসি ফুটে ওঠে তার। তার ঘরে যত্নে সাজিয়ে রাখা সেতারে সারারাত সুর তোলে হয়তো। সেতারের সুরে তাল বাঁধতে বাঁধতে যথাসময়ে মবিনের বাল-বাচ্চা হয়, আস্তে আস্তে সে বুইড়া হয়ে যায়। অতঃপর, একদিন মবিন মইরা যায়।



এখানেই এই গল্প শেষ হয়, কিন্তু এর বাইরে কি আরও কোনো একটা গল্প থাকতে পারে? এই প্রশ্ন সামনে রাইখা মবিনরে নিয়া একটু ভাবনা ভাবলাম। আমার সেই ভাবনার প্রয়োজনেই মবিন হয়তো বুইড়া হইয়াই ফট কইরা মইরা যায় না।



ই.

প্রেমের প্রথম দিনও মবিন খামাখাই দরজায় উষ্টা খাইছিল। ফলে সেই সেতারে তার আর সুর বাঁধা হয় না।



হয়তো এই কারণেই শিরিন সিরাজের সাথে ভাইগা যায়; ফলে, মবিন শিরিনকে পায় না। ঠিক একই কারণে হয়তো তার চাকরিটাও হয় নাই। বেকার মবিনকে শিরিন বিয়ে করে নাই ঠিকই, কিন্তু দীর্ঘদিনের ভালোবাসা তাদের। মাখামাখি। আবেগ। অনুভূতি।  ফলে, ভাইগা যাওনের আগের দিন মবিনকে সে জানায়— মরণের দিন আমি তোমার পাশে থাকবো। চাকরি তো আর নাই তোমার কপালে, যারা নাকি উষ্টা খায়, তাদের তো আর কোনোদিন চাকরি হয় না। তারা তো সেতার বাজায় না! জীবনে কখনো বিয়া করতে পারে না তারা। সিরাজের লগে ভাইগা যাওনের আগে সে এই কথাও বলে যায় যে, উস্টা খাওয়া রোগ মরণের আগে সারে না।



তারপর মবিন আবার ইন্টারভিউ দিতে যায়, ইন্টারভিউ ফেস করার আগে আবার সে উষ্টা খায়, ফলে এইবারও সে চাকরি পায় না। অথবা শিরিন যেদিন তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, সেদিনও সে উষ্টা খাইছিল— দরজার চৌকাঠের লগে; তাই তাদের বিয়ে হয় না।



জং ধরা পুরনো তারে তারে সেই সেতারে গায়ে আর সুর ওঠে না, এন্টিক হইয়া পইড়া থাকে বিপ্লবীদের পুঁজিবাদের শিল্পরসিক কোনো শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কাঁচঘেরা আলমিরাতে।



ঈ.

একদিন মবিন মিস্ত্রি ডেকে দরজার প্রশস্ততা বাড়ানোর প্রস্তুতি নেয়, ফলে আকালুরে ডাইকা আনে সে। আকালুর পূর্বপুরুষ কাঠ কোপায়, শহরে গরীবের ঘরে কাঠমিস্তিরির কামলা খাটে সে। কিন্তু বাড়িওলার ছোট জামাই সাদা লুঙ্গি পইরা পান খাইতে খাইতে আকালুরে গাইল দিয়া খেদায়া দিলে সে অত্যন্ত বিষণ্ন বোধ করে। অসহায় মবিন কাঠিপট্টির নয়াপীরের শরণাপন্ন হয়। কাঠপট্টির নয়াপীর তো খুব কামেল লোক, তার তাবিজের গুণের কথা সচেতন পাঠকেরা আগে থেকাই জাইনা থাকবেন। প্রবল আস্থাসহ মবিন নয়াপীরের তাবিজ আইনা ঝুলায়া রাখে তার ঘরের চৌকাঠে। তার মনে হতে থাকে যে, এবার হয়তো তার সব বিপদ কেটে যাবে, শিরিনও হয়তো আবার ফিরে আসবে তার কাছে । শেষ রাতে পুরনো সেতারে ঢিমেতালে বাজতে থাকবে ধ্রুপদী ভৈরবী রাগ।



অথচ সমস্যা মেটে না তার। চাকরি তো হয়ই না, এমনকি উষ্টা খাওয়া রোগও সারে না। আবারও নয়াপীরের শরণাপন্ন হয় সে। তাবিজের ভাঁওতা প্রকাশের পর নয়াপীর মাথা দুলাইতে দুলাইতে তাকে বলে, ‘মিয়া, বেহেস্ত থেকা আদম যখন উষ্টা খাইয়া দুনিয়াতে আইসা পড়লো, তখন থেকাই আমাগো সবতের কপালে উষ্টা লেখা হয়া গেছে। সারনের তো কোনো কায়দা নাই!’ (এইটাই হয়তো এই গল্পের গভীর দর্শন, যেহেতু সব গল্পের ভিতরেই একটা দর্শন থাকা দরকার)



উ.

অতঃপর একদিন রাতে হয়তো শিরিনকে স্বপ্নে দেখে সে। দেখে যে, সে বসে আছে মাঠের একপাশে, উদ্যানে। তার হাতে প্যাকেট ভরা বাদাম। এই বাদাম কোথা থেকে আসলো তার হাতে, কিভাবেই বা  আসলো, কিছুই মনে করতে পারে না সে। সে শুনতে পায় সেতারের দুঃখ জাগানো বিলাপ। তখন সে শুধু বাদামগুলা ফটাশ কইরা ভাঙ্গে আর খায়, ভাঙ্গে আর ফুঁ দেয়, তারপরে খায় আর খাওনের সময় শিরিনের কথাই মনে পরে তার। ফলে, শিরিনকে ডাকতে যায়; দূর থেকে শিরিনকে ফুল ছিঁড়তে দেখে সে। তাকে ডেকে বলে, শিরিন, এই দেখ, এইখানে এত বাদাম আমার কাছে, আর তুমি দূরে বইসা ফুল ছিঁড়ো? চলো, আমার লগে, এই মাঠে, উদ্যানের পাশে এই ভিজা ভিজা ঘাসের উপরে আমরা সেতার বাজাই? শিরিন খিলখিল করে হেসে উঠে যেন, একটু পরে কী ভেবে আবার মনমরা হয়ে পরে। তারপর বলে, এই বাদাম তো আমার কপালে নাই, আমার কপালে আছে খালি উষ্টা। মবিন ভাবে, সত্যিই তো তাই। অথবা হয়তো সে কিছুই ভাবে না, বিষণ্ন হইয়া তাকায়া থাকে, যেহেতু এই গল্পের দর্শন আগে থেকাই জানা আছে তার; ফলে, সে দেখে, যে তার হাতের প্যাকেট বাদামের খোসায় পূর্ণ, এক দানা বাদাম নেই সেখানে! ঘুম ভেঙ্গে যায় মবিনের। তবু, সেতারের শব্দ সেখানেই থামে না, যেন, গল্পের শেষ পর্যন্ত আবহ সঙ্গীতের মতো বাজতে থাকে ঢিমেতালে।



মবিন কখনো বিয়ে করে না, অথবা যেদিন তার আত্নীয়-স্বজনেরা তাকে শিরিন ছাড়া অন্য কারো না কারো সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু তখন সে পুনরায় উষ্টা খায়। ফলে সেদিনও সে বিয়ে করতে পারে না।



ঊ.

অতঃপর, এভাবেই জীবন-যাপন শেষে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে মবিন; কারণ শিরিন হয়তো তাকে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করিয়ে রাখে, অথবা মৃত্যু শিরিনের জন্য। সে বুইড়া হতে হতে মুমূর্ষু হয় দিনে দিনে। এবং একদিন নয়াপীরের তাবিজটা দরজার চৌকাঠ থেকে খুলে ডোবার পানিতে ফালায়া দেয়। তার চোখগুলি দিনে দিনে আধবুজা হইতে হইতে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়— আর সে অপেক্ষা করতে থাকে মৃত্যু, অথবা শিরিন, অথবা উভয়ের জন্যই।



কিন্তু শিরিন আসার পূর্বেই বুঝি মৃত্যু চলে আসে।



তবুও আমরা দেখতে পাই যে, মৃত্যুর আগে মবিনের চোখদুটি হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে— যখন সে দেখে নেয়— যেন মৃত্যু উষ্টা খায়; তার ঘরের চৌকাঠে।

Related Posts:

  • Islami Book web Address Visit for Islami Kitab Islamicbook Sultan.org Download free Bangla-english Text Books Nctb.gov.bd, For Direct download Primary & Secondary lev… Read More
  • আমার দেহের মানচিত্রে ...... !   স্বপ্ন দেখেছি বেলা বোস এর মত তোমায় নিয়ে লাল নীল সংসারের যেখানে রোজ সকালে চায়ের পেয়ালায় ঠোঁট ডুবানোর আগে তোমার ঠোঁটে এক চুমুক দিয়ে দিনের শু… Read More
  • আমিও স্বপ্ন দেখি ! তুমি কি জান নিকষ অন্ধকারে প্রচণ্ড নিস্তব্ধতায় কোন দীঘির মাঝে নৌকায় বসে পদ্ম পাতার উপর বৃষ্টির ফোটা পড়ার শব্দ শোনার অনুভূতি কেমন?  আম… Read More
  • নিষিদ্ধ জগতের নারী কাহিনী গ্ল্যামার, একশন, লাইট, সেট, কাট এসবই এই জগতের পরিচিত শব্দ। লোক দেখানো লৌকিকতায় নারী এখনো পণ্য। সেই জগতের হাতছানিতেই মডেল হবার স্বপ্ন কাজ করে … Read More
  • আমি আজ অবগুন্ঠন খুলে নীল জোৎস্নায় দাঁড়াব আজ সারাবেলা তোমার সঙ্গে থাকব সূর্যের আলো গায়ে মেখে, দেখব কতটা মাতাল হতে পারো! কিভাবে মাতোয়ারা হয় উদাসী দুপুর, বাতাসের বীণা হাতে কি করে বেজে… Read More

0 comments:

Post a Comment

" কিছু স্বপ্ন আকাশের দূর নীলিমাক ছুয়ে যায়, কিছু স্বপ্ন অজানা দূরদিগন্তে হারায়, কিছু স্বপ্ন সাগরের উত্তাল ঢেউ-এ ভেসে যায়, আর কিছু স্বপ্ন বুকের ঘহিনে কেদে বেড়ায়, তবুও কি স্বপ্ন দেখা থেমে যায় ? " সবার স্বপ্নগুলো সত্যি হোক এই শুভো প্রার্থনা!